ই-পেপার বৃহস্পতিবার ৫ ডিসেম্বর ২০২৪
বৃহস্পতিবার ৫ ডিসেম্বর ২০২৪
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার ৫ ডিসেম্বর ২০২৪

ছাত্রলীগ নেত্রী রিভার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়
ইডেন কলেজ যার মগের মুল্লুক
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৬ আগস্ট, ২০২২, ১:৩৫ এএম  (ভিজিট : ১০৮২)
রাজধানীর ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভার বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগের পাহাড় জমেছে। কমিটি দেওয়ার তিন মাস না পেরোতেই নিজের আধিপত্য তৈরিতে রিভা ইডেন কলেজকে মগের মুল্লুক বানিয়েছেন। 

আবাসিক হলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোর করে রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেওয়া, প্রতিবাদ করলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, সিটবাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এত কিছুর পরও ছাত্রলীগ থেকে নেওয়া হয়নি কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা। 

অভিযোগ রয়েছে, লেখক ভট্টাচার্যের কাছের হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পায় না। আর এসব ঘটনা দেখেও না দেখার ভান করে ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকা পালন করছে কলেজ ও হল প্রশাসন। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক থেকে শুরু করে ছাত্রলীগের অন্য নেত্রীদের মধ্যেও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রিভা।

সম্প্রতি রুপা ও মিথিলা নামের দুই ছাত্রীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন রিভা। তাদের হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকিও দেন। এ ঘটনার একটি অডিও সামাজিক  যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার মধ্যেই রিভা নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে স্ট্যাটাস দিয়ে বিষয়টির জন্য সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। 

তবে এর এক সপ্তাহ না যেতেই ভুক্তভোগী দুই ছাত্রীকে ডেকে এনে ওই ঘটনা ভাইরাল করার দায় ও অভিযোগ মিথ্যা বলে স্বীকার করাতে রাজিয়া বেগম ছাত্রীনিবাসের ২০২ নম্বর কক্ষে আটকে রেখে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করার অভিযোগ ওঠে। তাদের কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুমনা মীম ওই অডিও ভাইরাল করার নির্দেশনা দিয়েছেন-এমন স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করেন রিভা ও তার অনুসারীরা। আটকে রাখা অবস্থায় রিভা ওই দুই ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে তার ভিডিও ধারণ করে ভাইরাল করারও হুমকি দেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা ধরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পর রিভার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হন রুপা ও মিথিলা। পরে প্রাধ্যক্ষ নারগিস রুমা ওই দুই ছাত্রীকে উদ্ধার করেন। নির্যাতনের সময় হুমকি দিতে গিয়ে রিভা ছাত্রীদের বলেন, ‘আমি যদি একটা সিট না দিই, তোদের কোন বাপ সিট দেবে? ম্যাডামরা (হল প্রশাসন) দেবে? ক্ষমতা আছে ম্যাডামদের?’ সে সময় তিনি তাদের ‘এক পায়ে পাড়া দিমু, আরেক পায়ে টাইনা ছিঁড়ে ফেলব’ বলেও হুমকি দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রিভার নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগী কয়েকজন ছাত্রী সময়ের আলোকে বলেন, ‘ছাত্রীনিবাসে যেসব ছাত্রী থাকেন, তাদের রাজনৈতিক নানা কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাধ্য করেন রিভা। অসুস্থ থাকলেও তার কাছে কোনো ছাড় নেই।’ দীর্ঘদিন ধরেই এ কায়দায় নিপীড়ন চলিয়ে আসছিলেন রিভা। বিষয়টি নিয়ে অনেকেই ক্ষুব্ধ হলেও কেউ কিছু বলার সাহস করেননি। সেদিনের নির্যাতনের সময় ভুক্তভোগীরা সাহস করে ঘটনার অডিও রেকর্ড করেন। তবে যারা অডিও রেকর্ড করেছেন, তাদের কেউ নির্দেশনা বা পরামর্শ দেয়নি। তারা নিজে থেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বিষয়টি ধারণ করে রাখেন।

কলেজ শাখা ছাত্রলীগের একটি সূত্র জানায়, ইডেন মহিলা কলেজের সম্মেলন হয়েছিল ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই। এর প্রায় তিন বছর পর গত ১৩ মে রিভাকে সভাপতি এবং রাজিয়া সুলতানাকে সাধারণ সম্পাদক করে ইডেন ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ঘোষণার পরেই রিভাসহ কমিটির শীর্ষ নেত্রীদের অযোগ্য আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেছিল ছাত্রলীগের একাংশ। ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তামান্না জেসমিন রিভা। কমিটি ঘোষণার পর তাদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভও হয়েছিল। বিরোধীদের দমনেও নিজের গ্রুপকে শক্তিশালী করতে রিভা এই কৌশল গ্রহণ করেন। ইডেন কলেজের পাশে ফুটপাথে বিভিন্ন দোকান থেকে চাঁদাবাজি, সিটবাণিজ্য, বিনা কারণে ছাত্রীদের মারধর, ব্যক্তিগত কাজে সাধারণ ছাত্রীদের ব্যবহারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

জানা যায়, ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকার প্রাচীন এই কলেজটিতে মোট ৬টি ছাত্রীনিবাস রয়েছে। এসব হলে ছাত্রলীগের দখল সংস্কৃতির কারণে কৃত্রিম আবাসন সঙ্কট রয়েছে। আর এ সুযোগেই ছাত্রীনিবাসগুলোতে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের উঠতে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হয়। পরিচয় ও সম্পর্কের ভিত্তিতে এ অর্থের পরিমাণ ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে হয়। কেবল টাকা দেওয়াই শেষ নয়, শর্ত থাকে অংশগ্রহণ করতে হবে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক সব কর্মসূচিতেও। এ আসন-বাণিজ্য অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। এর বাইরে স্নাতক-স্নাতকোত্তরের পরও অনেক শিক্ষার্থী টাকার বিনিময়ে হলে থাকার সুযোগ পান। তাদের ক্ষেত্রে অর্থ দিতে হয় মাসিক হারে। আর এ বাণিজ্যের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। তাদের পক্ষে কয়েকজন অনুসারী নেত্রী এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। এমনকি কিছু কিছু সিটে বহিরাগত ছাত্রীদের রাখারও অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, পান থেকে চুন খসলেই ছাত্রলীগ নেত্রীরা সাধারণ ছাত্রীদের গালমন্দ, এমনকি মারধরও করেন। অনেক সময় হল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে এসব অনিয়মের বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রণ করেন তামান্না জেসমিন রিভা। তার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার কারণে সাধারণ ছাত্রীরা কোনো অনিয়মের বিষয়ে মুখ খোলেন না। সব কিছু জানার পরও হল ও কলেজ প্রশাসনকে কোনো ভূমিকা রাখতে দেখা যায় না।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তামান্না জেসমিন রিভা সময়ের আলোকে বলেন, ‘যে ঘটনায় বলা হচ্ছে আমি তাদের আটকে রেখে নির্যাতন করেছি, অথচ ওইদিন তাদের সঙ্গে আমার দেখাই হয়নি। আমি শোক দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এটা আমার অনুষ্ঠানকে নষ্ট করার পাঁয়তারা ছিল।’ 

সিটবাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘হলে আমাকেও বৈধভাবে থাকতে হয়। হলে থাকতে হলে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েই থাকতে হয়। প্রশাসনের কাছে জবাবদিহি থাকে। আর কলেজের সামনে দোকান আছে, কি নেই তা-ই আমি জানি না। সেখানে দোকান বসে কি না আমি কখনই খেয়াল করিনি। আমি আমার স্কুটি নিয়ে যাতায়াত করি। আর কলেজের সামনে তো দোকান বসার নিয়ম নেই। সিটি করপোরেশন ও পুলিশের পক্ষ থেকে দোকান উঠিয়ে দেয়। এটা তো সিটি করপোরেশনের বিষয়। এটি তো আমার বা কলেজের জায়গা না, যে আমি দোকান বসাব। এ বিষয়ে আমি আসলেই কিছু জানি না।’ 

ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের অবস্থান জানতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ফোন করা হলেও তারা সাড়া দেননি। 

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সোহান খান সময়ের আলোকে বলেন, ‘ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি যে কাজটি করেছেন তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। তিনি প্রথম ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষমা চেয়ে পোস্ট করেছেন। তার মানে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। তারপর তার চুপ থাকা উচিত ছিল। তা না করে তিনি জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করার চেষ্টা করেছেন। এ ধরনের ঘটনার বিচার হওয়া উচিত। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছাত্রবন্ধব সংগঠন। এসব ঘটনার কারণে ছাত্রলীগের অন্য নারী সদস্যদের ছোট হতে হয়। অভিযোগ সত্যি হলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা প্রয়োজন ছিল। তবে ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এ বিষয়ে গাছাড়া মনোভাব দেখাচ্ছেন। তারা এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না, কারণ তাদের স্বাক্ষরেই রিভা নেত্রী হয়েছেন।’

/আরএ


আরও সংবাদ   বিষয়:  মগের মুল্লুক   ছাত্রলীগ নেত্রী রিভা  




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close