আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়
ড. মিল্টন বিশ্বাস
|
![]() ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, বঙ্গবন্ধু জেলে থাকলেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ১৯৪৮ থেকেই সম্পৃক্ত হন। ভাষা আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে পূর্ববাংলা আইন পরিষদে যাওয়ার বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন ও দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। একই বছর আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান। পরের বছর তাঁকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৩ সালের কাউন্সিল সভায় পুরোদস্তুর সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল থাকেন। ১৯৫৪ সালে ১০ মার্চ পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ ছিল মূল নেতৃত্বে। একই বছর ৩ এপ্রিল যুক্তফ্রন্ট পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাদেশিক শাসনভার গ্রহণ করে। কিন্তু মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে ৩০ মে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগারে কাটাতে হয়েছে ৩০৫৩ দিন। মনে রাখা দরকার ১৯৫৪ সালের ৭ মে বঙ্গবন্ধুর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৯৫৬ সালে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি কার্যকর হয়। পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে একটা বিধান ছিল, সরকারের মন্ত্রী হলে তাঁকে দলীয় পদ ছেড়ে দিতে হবে। এই বিধান মেনে নিয়ে ১৯৫৭ সালে শেখ মুজিব প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিত্ব পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব ১৯৬৬-৭৪ সময়কালে ৮ বছর দলের সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা এবং ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দলকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। ৬ দফা আন্দোলন সাধারণ মানুষকে আওয়ামী লীগের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল করে তোলে, পরিণতিতে ৬ দফা পরিণত হয় ১ দফায়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল দলীয় আন্দোলনের পরিপক্ব প্রকাশ। ১৯৭০ সালে তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় ১৮ মিনিট ব্যাপী ভাষণ দেন। সেখানেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলেও দলের নেতারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যার মধ্যে নিজেদের রক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এপ্রিলের ১০ ও ১৭ তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকার গঠন করে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করা এবং জয়ী হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্পন্ন করার মধ্যে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অবদান অবিস্মরণীয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে বাহাত্তরের এপ্রিলে আবারও দলের সভাপতি করা হয়। তবে তিনি দলের গঠনতন্ত্রে হাত দেননি। দলীয় সরকারের অন্যতম কাজ ছিল জাতিকে শাসনতন্ত্র উপহার দেওয়া। বঙ্গবন্ধুর তত্ত্বাবধানে বাহাত্তরে সংবিধান প্রণীত হলে এ দেশ পরিচালনায় সরকার আইনি বৈধতা পায়। অবশ্য ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সভাপতির পদ ছেড়ে দেন। নতুন সভাপতি নির্বাচিত হন আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান। তবে সরকার ও দলের মধ্যে ক্ষমতার যে কেন্দ্রীভবন ঘটেছিল এবং শেখ মুজিবের যে বিশাল ব্যক্তিত্ব ছিল, তাঁকে কেন্দ্র করেই সরকার এবং দল আবর্তিত হচ্ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পেশকৃত চতুর্থ সংশোধনী বিল পাস হয়। এর মাধ্যমে দেশের সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে একদলীয় শাসন তথা বাকশাল গঠনের পথ উন্মুক্ত হয়। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। বিল পাসের সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতিতে পরিণত হন। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে আওয়ামী লীগ সরকারের কাজ হচ্ছে- মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, ত্রাণ কার্যক্রম, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ, স্বাধীন বাংলার প্রশাসনিক পদক্ষেপ, ভারতীয় বাহিনীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন, ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন, প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, পররাষ্ট্রনীতিতে ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরী মনোভাব নয়’ প্রতিষ্ঠা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন, যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু, ২৫ বছর মেয়াদের বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি, শিক্ষা কমিশন গঠন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পুনর্গঠন, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণ প্রদান, প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, পাঁচ হাজার টাকার ওপরে কৃষিঋণ মওকুফকরণ এবং ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমিয়ে এনে সামাজিক অর্থে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জমি মালিকানার সিলিং পুনর্নির্ধারণ, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নতুনত্ব, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা, বৈদেশিক বাণিজ্যের সূচনা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা উল্লেখযোগ্য। এই উন্নয়নের ধারা ব্যাহত করেন মোশতাক-জিয়া প্রভৃতি খুনিচক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে। তারা বঙ্গবন্ধু যুগের অবসান করেন এবং একইসঙ্গে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার চেষ্টায় মত্ত হন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগের নতুন সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পুনর্জন্ম দেয় দলকে। নেতাকর্মীরা তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলকে ক্ষমতায় আনেন ১৯৯৬ সালে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। দলের প্রধান এবং সরকারের প্রধান একই ব্যক্তি। ১৯৮১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৪১ বছর শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। ফলে ইমডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল থেকে শুরু করে, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার ও ফাঁসি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসি এবং ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ফলে ১৯৭২-এর সংবিধানের মূলনীতি পুনর্বহাল, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার প্রথা চালু, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি, নারীদের জন্য ৫০ আসন সংরক্ষণ, দ-িত যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অযোগ্যসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি ঘটে। ডিজিটাল বাংলাদেশের ব্যাপক প্রসার হওয়ায় ২০২০ সালে করোনা সঙ্কটে সেই সুবিধার বিপুল প্রয়োগ, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল প্রতিষ্ঠা, নিজস্ব টাকায় পদ্মা সেতু তৈরি, ভারতের সঙ্গে ছিটমহল সমস্যার সমাধান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণসহ আরও কিছু স্মরণযোগ্য ঘটনা। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো শপথ নেন। ২০২০ সালে মুজিববর্ষ পালন ও করোনা মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আওয়ামী লীগ। ২০২১ সালে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করা হয় ৩ দিন ব্যাপী। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম নানা কারণে হতাশাব্যঞ্জক। নেতাকর্মীর সুসম্পর্ক এবং যোগাযোগ এখন নেই বললেই চলে। সবকিছু শেখ হাসিনাকেন্দ্রিক হওয়ায় নতুন নেতৃত্বের ওপর সাধারণ নেতাকর্মীদের আস্থার সঙ্কট প্রায়ই দেখা যায়। নতুন নেতৃত্ব এবং আত্মত্যাগী নেতা ছাড়া দল টিকতে পারে না। সাধারণ কর্মীদের অনুপ্রাণিত করার জন্য দল গোছানোর কথা বলা হলেও নিজের দলের মধ্যে নানা ধরনের বেআইনি কাজ আওয়ামী লীগকে প্রশ্নের সম্মুখীন করছে। ফলে দলের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য নিজেদের সতর্ক ও দুর্নীতিমুক্ত রাখা খুবই জরুরি। অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আরএস/ |