হাঁটতে চেয়েছিল তালগাছটি
জহির টিয়া
|
![]() ঝড়ঝাপটায় নিজে মাথা পেতে অন্যদের রক্ষা করে। এই তো কয়েকদিন আগেও সজনেগাছটাকে কালবৈশাখী ঝড়ের কবল হতে রক্ষা করল। তাতে তার একটা হাত ভেঙে গিয়ে পড়ে পুকুরের জলে। তাতেও তার কষ্ট নেই। আশপাশের সবাইকে নিয়ে তালগাছটি বেশ সুখেই ছিল। তবে ইদানীং তার একটা দুঃখ জমেছে বুকের ভেতর। যেনতেন দুঃখ নয়। একটা পুচকে ছাগলের অহঙ্কার দেখে দিন দিন তালগাছটির দুঃখ বাড়ছে। প্রতিদিন ছাগলটি তালগাছের আশপাশে চরতে আসে। ঘাস, লতা-পাতা খায় আর তালগাছের পাশে বসে জাবর কাটে। মাঝেমধ্যে এটা-ওটা নিয়ে তালগাছের সঙ্গে কথাও বলে। এক খাঁ খাঁ দুপুরে ছাগলটি তালগাছের ছায়ায় বসে আরাম করছিল। এমন সময় ধপাশ করে একটা পাকা তাল পড়ল পুকুরজলে। পানিতে তাল পড়ার শব্দে ভীষণ ভয় পেল ছাগলটি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কানঝাপটাও দিল। ‘তালগাছ এ কেমর আচরণ তোমার?’ ছাগলটি কর্কশ কণ্ঠে বলল। ‘কেন? কী হয়েছে?’ তালগাছ জানতে চাইল। ‘তুমি শুধু লম্বা হতেই শিখেছ। বুদ্ধিসুদ্ধি একটুও হয়নি।’ ‘কী এমন করলাম যে তুমি এত বড় কথা বললে? কিসের আমার বুদ্ধিসুদ্ধি হয়নি?’ ‘তোমার এতটুকু জ্ঞান থাকলে আমার আরামের সময় এভাবে তালকে জলে ছুড়ে ফেলতে না। তা ছাড়া তাল তো তোমারই সন্তান। কেমন মা তুমি? নিজের সন্তানকে জলে ছুড়ে মারলে। ছিঃ ছিঃ!’ ‘তুমি জানো না। ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। আমার সন্তানদের ছুড়ে ফেলি অন্যের সুখের জন্য। ওই যে পুকুরজলে তাকিয়ে দেখো, আমার সন্তানকে মাছেরা কীভাবে আনন্দ করে খাচ্ছে আর তাদের খিদা নিবারণ করছে। আমার সন্তানদের জন্মই হয় অন্যের উপকারের জন্য। তুমি অন্যের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করো। এখানে-ওখানে বাউণ্ডুলের মতো ঘুরে বেড়াও আর সবার ক্ষতি করো।’ ‘তোমার তো হাঁটার ক্ষমতা নেই। দৌড়ানোর ক্ষমতা নেই। অলসের মতো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিবছর সন্তানদের বিসর্জন দাও। দেখতে পাও না, আমরা সন্তানদের কত আদরযত্নে রাখি। ঘুম পাড়িয়ে দিই। খাইয়ে দিই।’ ‘ছোটো মুখে এত বড় কথা! আমার হাঁটার ক্ষমতা নেই! দৌড়ানোর ক্ষমতা নেই! আমি হাঁটতে, দৌড়াতে পারি কি না দেখিয়ে দেব। কাল সকালে এসে দেখে যেও।’ সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। তালগাছকে ঘিরে যারা চলাফেরা করে, তার সুস্বাদু ফল খায়, তাদের কাছে খবর পৌঁছে গেল। আগামীকাল তালগাছ হেঁটে বহুদূরে চলে যাবে। অহঙ্কারী ছাগলের আশপাশে থাকবে না। তালগাছকে ঘিরে একে একে সবাই জড়ো হতে শুরু করেছে। পুকুরের মাছগুলো পুকুর কিনারে, আশপাশের ছোট ছোট গাছ, বাবুইপাখিসহ অন্য পাখিরা, জোনাকিরা, মৌমাছিরা, মাছিরাসহ আরও অনেকেই। সবার অনেক পরে ছুটে এলো মেঘেরা। তারা একটু দেরিতে খবর পেয়েছিল। সবার একটাই দাবি, কোনোমতেই তালগাছকে এখান থেকে যেতে দেবে না। এভাবে সবাইকে একসাথে দেখে মুখখানা ভার করেই তালগাছটি বলল, ‘তোমরা কী চাও? একসাথে কী মনে করে এসেছ?’ প্রথমেই আশপাশের গাছগুলো একসাথে বলে উঠল, ‘পুচকে ছাগলের কথায় তুমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছ, তা আমরা মানতে পারছি না। তুমি আমাদের বিপদ দিনের ভরসা। তোমাকে এখান হতে কোথাও যেতে দেব না।’ পুকুরের মাছগুলো খলবলিয়ে চিকন সুরে বলল, ‘তুমি আছ তাই প্রচণ্ড গরমেও শীতের ছোঁয়া পাই। তোমার ছায়ায় পুকুরের যে অংশটুকু ছায়া পায়, সেখানে গিয়ে আমরা সুখে থাকতে পারি। তা ছাড়া তালের মৌসুমে তাল খাওয়াও, যা খেয়ে দারুণ তৃপ্তি পাই। আমরা তোমাকে যেতে দেব না।’ বাবুইপাখিরা বলে উঠল, ‘না না আমরা তোমাকে যেতে দেব না। তুমি চলে গেলে আমরা ঘরহীন হয়ে পড়ব। সারা দিন টইটই করে ঘুরে এসে তোমার ওপর শান্তিতে ঘুমাতে পারি। নিজ জন্মভ‚মি ছেড়ে যেও না। অন্যের কথায় কান দিয়ে আমাদেরকেও নিজ জন্মভ‚মি ত্যাগ করিও না।’ জোনাকিরা মিটিমিটি আলো জ্বেলে ফিসফিসে কণ্ঠে বলল, ‘আমরাও তোমাকে যেতে দেব না। তুমি আমাদের ঠিকানা। যতই দূরে যাই, পথ ভুলি না। তোমাকে দূর হতে দেখেই নিজেদের বাসায় ফিরে আসতে পারি। কেউ বাসা কোথায় জিজ্ঞেস করলে বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, ওই পুকুরপাড়ের তালগাছের কাছেই আমাদের বাসা। দুষ্টু ছাগলের কথায় আমাদের ঠিকানাহারা করো না।’ তালগাছকে ঘিরে হেলেদুলে উড়তে উড়তে মেঘেরা বলল, ‘ভাই তালগাছ, আমারও চাই না তুমি এখান থেকে অন্য কোথাও যাও। আমরাও তোমাকে আমাদের কেন্দ্রবিন্দু ধরে বাতাসে সাঁতার কেটে বেড়াই। দূরদূরান্তে ছুটে বেড়াই। তুমি এখান থেকে যেতে পারো না।’ এভাবে একে একে উপস্থিত অন্যরাও আপত্তি জানাল। জোরালো দাবি জানাল, তালগাছকে এখানে থেকে যাবার। সবার কথা শুনে তালগাছ তার ভুল বুঝতে পারল। সে ভাবল, সবার ভালোবাসা ছেড়ে একটা পুচকে ছাগলের কথায় কোথাও যাওয়া মোটেও ঠিক হবে না। তালগাছ সবাইকে থামিয়ে, সবার দাবি মেনে বলল, ‘আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি কোথাও যাব না। সুখে-দুঃখে তোমাদের পাশে ছিলাম এবং থাকব।’ তালগাছের কথায় সবাই হুর-রা দিয়ে উঠল। মুহুর্মুহু করতালিতে আনন্দ করতে লাগল তালগাছকে ঘিরে। আরএস/ |