শরিকদের দুঃখগাথা: ১৪ দলে পাওয়া না পাওয়ার বেদনা
সমীরণ রায়
|
![]() এদিকে জোটনেত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাসের পরও একলা চলো নীতিতেই হাঁটছে আওয়ামী লীগ। দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ১৪-দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর সভাপতিত্বে দুয়েকটি ভার্চুয়াল বৈঠক ছাড়া আর কোনো কর্মসূচি নেই। এতে ১৪ দলের শরিক নেতারা অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েছেন। শরিক দলগুলোর নেতারা মনে করেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নেই কোনো কর্মপরিকল্পনা ও যুগপৎ কর্মসূচি। এমনকি ১৪ দল কোন কৌশলে এগোচ্ছে, তাও পরিষ্কার নয় শরিক দলগুলোর কাছে। গত ১৫ মার্চ বৈঠকে আগামী নির্বাচনে শরিকদের প্রত্যেককে আসন দেওয়ার কথা জোটনেত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করলেও তা নিয়েও দেখা দিয়েছে ধোঁয়াশা। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর শরিক দলের একাধিক নেতাকে মন্ত্রী করা হয়। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর শরিকদের মন্ত্রিসভায় আর রাখা হয়নি। এ নিয়ে শরিকদের মধ্যে রয়েছে চাপা ক্ষোভ ও দুঃখ। বুক ফেটে গেলেও মুখ ফুটে বলতে পারছেন না তারা। এতে করে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব বাড়ছে জোটে। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মহাজোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া। এরপর আর তাকে মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। এ সময় ঢাকা-৮ আসনে এমপি হন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। পরে ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর মেননকে সর্বদলীয় সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী করা হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-৮ আসন থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মহাজোট সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মন্ত্রিসভায় তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে টানা সাত বছর ছিলেন। তিনি এখন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি। পরে তাকে আর মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। এরপর আর ১৪ দলের শরিকদের কাউকে মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। কেন্দ্রীয় ১৪ দলের শরিকদের একাধিক নেতা বলেন, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জোটের কর্মপরিকল্পনা আছে কি না জানা নেই। আমরা ঐক্যবদ্ধ রয়েছি, তার কোনো আভাস নেই। আওয়ামী লীগ এখন একলা চলো নীতিতে রয়েছে। যেটি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শামিল। জোট নিয়ে তাদের আগামী দিনের কৌশল কী তাও পরিষ্কার নয়। ফলে জোটের ভেতরে ভেতরে অনেক নেতাই ক্ষুব্ধ। বাড়ছে দূরত্বও। এভাবে চললে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন মোকাবিলা করা কঠিন হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সময়ের আলোকে বলেন, ১৪ দল গঠিত হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও উগ্রসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। কিন্তু সেটি মনে হয় এখন আর তেমন নেই। ১৪-দলীয় জোটের সব কিছুই নির্ভর করে আওয়ামী লীগের ওপর। ইতোমধ্যে একটা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। কোনো ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচিও নেই। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জোটনেত্রী ১৫ মার্চ বৈঠকে আমাদের ১৪-দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধ থাকবে এমন আশ্বাস দিলেও এখনও অনেকটা অস্পষ্ট। কারণ আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে কোনো কিছুই হয় না। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ না রাখলে আমরা এককভাবে প্রার্থী দেব। এ প্রসঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু সময়ের আলোকে বলেন, ১৪-দলীয় জোট মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি জোট। তবে জোট নিয়ে এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ কী কৌশল নিয়েছে, সেটি পরিষ্কার নয়। আওয়ামী লীগ কী করবে সেটি তাদের ব্যাপার। আমাদের দলের বিভিন্ন কর্মসূচি থাকলেও ১৪ দলের দুয়েকটি ভার্চুয়ালি বৈঠক ছাড়া ঐক্যবদ্ধ কোনো কর্মসূচি নেই। আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম সময়ের আলোকে বলেন, এটা সম্পূর্ণ নেত্রীর ব্যাপার। তিনি যা ভালো মনে করেন, সেভাবেই ১৪ দলকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। জাতীয় পার্টির (জেপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, ১৪ দল হালুয়া-রুটির জন্য হয়নি। তবে আগামী দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে সবারই কিছু পাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে। সেখানে আওয়ামী লীগ কী দেবে না দেবে, তা নিয়ে এখনও কোনো আলোচনা হয়নি। ১৪ দলের অনেকের মধ্যে ক্ষোভ থাকতেই পারে। কারণ যারা পাওয়ার জন্য ১৪ দলে আসছেন, তাদের ক্ষোভ থাকবে, এটা স্বাভাবিক। আমরা রাজপথে নেই এ কথা সত্য। উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই ১১ দল, আওয়ামী লীগ, জাসদ ও ন্যাপসহ (মোজাফফর) মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল দলগুলোকে নিয়ে ১৪ দলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ওইদিন ১৪ দল প্রণীত ৩১ দফা নির্বাচনি সংস্কারের রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ২০০৫ সালের ২২ নভেম্বর পল্টন ময়দানে ১৪ দলের ২৩ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। আওয়ামী লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও ১১-দলীয় জোট মিলে এই জোট গঠিত হয়। কিন্তু জোট গঠনের পরপরই ১১ দল থেকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলসহ (বাসদ) কয়েকটি দল বেরিয়ে যায়। কিন্তু জোটটি ১৪ দল নামেই বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ৪-দলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলে। পরে ২০০৭ সালের ১/১১-এর পর ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে ড. কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন গণফোরাম। তবে ১৪ দলে যোগ দেয় আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) ও নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারি নেতৃত্বাধীন তরিকত ফেডারেশন। এ ছাড়া ২০১৬ সালে কাউন্সিল ঘিরে দুভাগে বিভক্ত হয় জাসদ। শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশ জাসদ। এই দল থেকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসনে এমপি নির্বাচিত হন মাঈনুদ্দীন খান বাদল। তার মৃত্যুর পর ওই আসনে আওয়ামী লীগ কোনো ছাড় দেয়নি। /জেডও
|