মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা: দাম বেড়েছে ওষুধের
এম মামুন হোসেন
|
![]() এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাড়তি দামের জেরে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষের। তার ওপর হঠাৎ ওষুধের দাম বৃদ্ধি দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে তাদের। ওষুধের দাম বাড়লেও কঠোর হতে পারছে না ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। কাঁচামাল, ডলারের দাম বৃদ্ধি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুুহাতে ওষুধের দাম বাড়ানোর কথা জানিয়েছে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। দাম বাড়াতে না দিলে উৎপাদন বন্ধের হুমকিও দিয়েছে তারা। তবে কোম্পানিগুলো যাতে ইচ্ছামতো দাম বাড়াতে না পারে সেটি নজরদারির জন্য একটি কমিটি করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। জুলেখা বেগম সময়ের আলোকে বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলের উপার্জনে সংসার চলে। বাড়ি ভাড়া, সংসারের খরচ, ছেলের বেতনের টাকায় হয়। আমার ওষুধ কিনি স্বামীর পেনশনের টাকায়। আগে ওষুধ কিনে কিছু টাকা থাকত। তা দিয়ে নাতি-নাতনিদের কিছু কেনাকাটা করে দিতাম। এখন এই টাকায় নিজের ওষুধই কেনা হচ্ছে না। শাহবাগের ভিআইপি ড্রাগ হাউসের মালিক এমএম কামাল সময়ের আলোকে বলেন, দেশের বাইরে থেকে যেসব ওষুধ আসে সেগুলোর দাম বেড়েছে। দেশীয় উৎপাদিত কিছু ওষুধের দাম বেড়েছে। বৃহৎ পাইকারি ওষুধ মার্কেট মিটফোর্ডের ওষুধ বিক্রেতা লাইজু রহমান জানান, চলতি মাসে অনেক ওষুধের দাম বেড়েছে। আবার অনেক ওষুধের কৃত্রিম সঙ্কট আছে। কোম্পানিগুলো চাহিদামতো ওষুধ দিচ্ছে না। মিটফোর্ডে মায়ের জন্য স্ট্রিপ নিতে এসেছেন জুয়েল হোসেন। তিনি বলেন, ২৫ স্ট্রিপের অ্যাকুচেক এখন ৭৫০ টাকা দিতে হয়েছে। এপ্রিলের শুরুতে আমি ৫০০ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। তিনি আরও বলেন, তার বাসার আশপাশে এটি এখন পাওয়া যাচ্ছে না। অতিপ্রয়োজনীয় ইনহেলার সলিউশন কন্টেইনারের দামও ৩০ টাকা বেড়ে এখন ২৫০ টাকা হয়েছে। রাজধানীর কয়েকটি ফার্মেসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পোরেভেনান ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন প্রতি প্যাকেট আগে বিক্রি হতো ৫ হাজার ৬০০ টাকায়। এখন বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার টাকার ওপরে। অ্যালবুটিন ২০% ইনজেকশন রক্তক্ষরণ প্রতিরোধ করে এবং কিডনি ও লিভার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। ইনজেকশনটি ৬ হাজার ৪০০ টাকায় পাওয়া গেলেও এখন ৬ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেটোস্টেরিল ট্যাবলেট ১০০ ফিল্ম-কোটেড প্রতি প্যাকেটে সাড়ে তিনশ টাকা বেড়েছে। সোলু মেড্রোল (আইজি) অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন ২ হাজার ৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। আগে এর দাম ছিল ১ হাজার ৬৫০ টাকা। চর্মরোগের চিকিৎসার জন্য সেবিয়াম ফোমিং জেল বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ টাকায়। ঈদের আগে জেলটি ১ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি করা হতো। সেবিয়াম সেনসেটিভ আগে বাজারে প্রতি প্যাকেট পাওয়া যেত ১ হাজার ৮০০ টাকায়। এখন ২ হাজার টাকা। ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য ডায়ালিপটিন ৫০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেটের একটি ইউনিট এখন বিক্রি হচ্ছে ১৬ টাকায়। আর তিনটি স্ট্রিপ সম্বলিত এক বক্স ওষুধ বিক্রি হচ্ছে ৬৭০ টাকায়, যা এক মাস আগেও ৬৩০ টাকা ছিল। প্রতি ইউনিটের দাম বেড়েছে ৬ শতাংশের বেশি। একটি ফ্লেক্সিপেন (ইন্সুলিন পেন) এখন ৩৯০ থেকে ৪৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একটি সুঁইয়ের দাম ১ টাকা বেড়ে এখন স্থানীয় মার্কেটে বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকায়। রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করার স্ট্রিপের দামও বেড়েছে। হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য মুখে খাওয়ার ওষুধ র্যানসিস এএম আগে প্রতি বক্স ২৪০ টাকায় বিক্রি হতো। এখন তা ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হৃদরোগের চিকিৎসার ওষুধ ট্যাবলেট রিপ্লেট ৭৫ এমজির প্রতি বক্সের দাম ৩০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকায়। গ্যাস্ট্রিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত ৪০ মিলিগ্রাম ট্রুপন ট্যাবলেটের একটি বক্স এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকায় (৬০ ট্যাবলেট)। এর প্রতি ইউনিটের মূল্য এখন ৮ টাকা। এর আগে মার্চ মাসে এর দাম ছিল ৩৫০ টাকা। এখন প্রতি বক্সের দাম বেড়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ। হাঁপানি রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ৪ এমজি ট্যাবলেট লুমোনা প্রতি বক্সের দাম বেড়েছে ১৬৮ টাকা। এই ট্যাবলেট আগে ৫০৪ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৬৭২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেটের দামও বেড়েছে। মাল্টি-ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট সুপার এক বক্স ট্যাবলেট এখন বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়। এক মাসের ব্যবধানে এর দাম বেড়েছে ৬০ টাকা। এ ছাড়া ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট ক্যালডিল ট্যাবলেট এখন ২১০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। আগে এর দাম ছিল ১৫০ টাকা। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ সময়ের আলোকে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে ওষুধ অন্যতম। অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে ওষুধের দামও বেড়ে গেছে। ওষুধ প্রস্তুতের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বিশ্বব্যাপী সব কিছুর দাম বেড়েছে। কিন্তু এ সুযোগে লাগামহীন দাম বাড়ালে জনগণের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা বাড়াচ্ছে। আন্তরিকতার সঙ্গে বিষয়টি দেখতে হবে। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ সময়ের আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ওষুধের কাঁচামালের দাম বেড়েছে। তেলের দাম বেড়েছে, ডলারের দাম বেড়েছে, আমদানি খরচ বেড়েছে। এসব কারণে প্রস্তুতকারীরা ১০০ থেকে ২০০ শতাংশ হারে ওষুধের দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। আমরা দেশের বাজারে ওষুধের দাম খুব এটা বাড়াতে দিচ্ছি না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দাম বাড়াতে না দিলে ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করে দিলে তো আরও বিপদ। চারদিক দিয়ে আমরা ঝামেলায় আছি। ওষুধ কোম্পানিগুলো উৎপাদন বন্ধের হুমকি দিয়েছে। বিষয়টি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছি। এ ছাড়া ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর একটি কমিটি করে দিয়েছে। কত শতাংশ দাম বেড়েছে আর কত শতাংশ বাড়ানো উচিত- কমিটি এসব তদারকি করবে। /জেডও |