দেশে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুহার কমাতে শিশুদের সাঁতার শেখাতে ২৭১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেয়েছে। প্রকল্পের আওতায় সাঁতার শিখতে ২টি দলে বিদেশ যাবেন ১৬ কর্মকর্তা। এক্ষেত্রে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। এদিকে সাঁতার শিখতে কেন বিদেশ যেতে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) নাসিমা বেগম সময়ের আলোকে বলেন, শুধু সাঁতার শিখতে নয়, বাচ্চাদের সুরক্ষা, বিকাশ এবং বাচ্চাদের ছোটবেলাটা কীভাবে সুন্দর করে কাটানো যায়, এর জন্য প্রশিক্ষণের দরকার আছে। চাইল্ড কেয়ারের বিষয়টি কর্মকর্তাদের শেখাতে এই বিদেশ সফরের অপশন রাখা হয়েছে। তারা মূলত শিশুদের বাবা-মা যখন ঘরের বাইরে কাজে ব্যস্ত থাকেন সে সময়টা সন্তানদের কীভাবে ডে-কেয়ারে রেখে সুন্দর লাইফ দেওয়া যায় সেটাই দেখতে যাবেন।
তিনি বলেন, দুইটি টিমে ৮ জন করে ১৬ জন কর্মকর্তা বিদেশ যাবেন। এর জন্য ব্যয় হবে ৩০ কোটি টাকা। আর বাকি টাকা রাখা হয়েছে পরবর্তী সময়ে বিদেশে কোনো সেমিনার হলে সেখানে পাঠানোর জন্য। এদিকে প্রকল্পটির আওতায় ৯৮০ কর্মকর্তা দেশেই সাঁতার শেখার প্রশিক্ষণ নেবেন, যেখানে ব্যয় হবে ১১ কোটি ৪ লাখ টাকা। একেকজনের বিদেশ ভ্রমণে খরচ পড়বে ১ লাখ ১২ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে নাসিমা বেগম বলেন, এখানে শুধু ৯৮০ জন কর্মকর্তাই নন, আরও অনেককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এখানে বেশি ব্যয় রাখা হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, দিনের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে ৫ বছরের নিচের বয়সি শিশুদের বিকাশ উপযোগী সেবা প্রদান, ১-৫ বছর বয়সি শিশুর জন্য কেন্দ্রভিত্তিক সমন্বিত ইসিসিডি সেবা প্রদান যাতে শিশুর শারীরিক, সামাজিক, আবেগিক, ভাষাগত এবং জ্ঞানবুদ্ধির বিকাশ নিশ্চিত হয়, ৬-১০ বছর বয়সি শিশুদের নিরাপদ সাঁতার শেখানোর মাধ্যমে তাদের পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে সুরক্ষা প্রদান, জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ে ইসিসিডি বিষয়ে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার সামর্থ্য বৃদ্ধি যাতে সংস্থাগুলো শিশুদের নিরাপত্তা এবং বিকাশে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। শিশুর বিকাশ ও সুরক্ষার সর্বোত্তম পরিকল্পনা এবং সমন্বিত কার্যক্রমে পরিবার এবং এলাকাবাসীর সম্পৃক্ততার কার্যক্রম গ্রহণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অভিভাবকদের শিশু লালন-পালন বিষয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
প্রকল্প গ্রহণের যৌক্তিকতা হিসেবে বলা হয়েছে, শিশুর সুষ্ঠু শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও আবেগীয় বিকাশে জীবনের প্রথম আট বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু মৌলিক চাহিদা, বিশেষ করে খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা এবং শিক্ষার চাহিদা পূরণ করা শিশুদের বেঁচে থাকা ও জীবনকে পরিপূর্ণ সম্ভাবনাময় করার জন্য অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশ পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু মৃত্যুহার হ্রাস, প্রসবকালীন মৃত্যুহার হ্রাস এবং প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু অপর্যাপ্ত সমন্বিত প্রারম্ভিক শিশুযত্নের ব্যবস্থা এবং অন্যান্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে বাংলাদেশের অনেক শিশুই গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে। এই বয়সি শিশুমৃত্যুর বিভিন্ন কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ পানিতে ডুবে মৃত্যু।
প্রস্তাবিত প্রকল্পে ৩টি লক্ষ্য নিয়ে ২০১৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতর পরিচালিত বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও দুর্ঘটনা সমীক্ষায় বিশেষ বিষয় হিসেবে দেখানো হয়েছে, প্রতিবছর প্রায় ১৯ হাজার ২৪৭ জন মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়, যার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই শিশু। এই সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৫ বছরের কম বয়সি শিশুরা সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মধ্যে আছে। এই মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটে সাধারণত বাড়ির ২০ মিটারের মধ্যে অবাঞ্ছিত জলাধারে এবং দিনের প্রথমভাগে। গ্রামাঞ্চলে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার এই হার শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি, যার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে সেখানে পুকুর আর ডোবার মতো ছোট ছোট জলাধারের সংখ্যা বেশি।
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক (২০২০) এক গবেষণায় দেখা গেছে, পানিতে ডুবে মৃত্যু শতকরা ৮৮ ভাগ পর্যন্ত প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে ৩টি কৌশল সবচেয়ে কার্যকর। এগুলো হলো ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী শিশু-যত্নের সুযোগ সৃষ্টি করা। পানিতে সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ওপর জোর দিয়ে ৬-১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো এবং শিশুদের নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং তা হ্রাস করার পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণ, মা-বাবা ও অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
প্রস্তাবিত প্রকল্পে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৩টি প্রতিরোধ কৌশলই অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্প মেয়াদে ১৬টি জেলায় ৪৫টি উপজেলার নিম্নোক্ত ৩টি লক্ষ্য নিয়ে কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। যেগুলো হলো, ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য ৮ হাজারটি কমিউনিটিভিত্তিক সমন্বিত শিশু-যত্ন কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা। এ ছাড়া ৬-১০ বছরের শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ১ হাজার ৬০০ জন প্রশিক্ষককে সাঁতার প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্যারেন্টিং সেশন পরিচালনা যেখানে শিশুর যত্ন, বিকাশ ও শিশু সুরক্ষার সর্বোত্তম চর্চার বিষয়ে তথ্য প্রদান এবং সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করা।
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রতিবছর দেশে বিপুলসংখ্যক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। শিশুদের সাঁতার শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকদের যদি এ বিষয়ে সচেতন করা যায় তাহলে এ মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৮,০০০টি সমাজভিত্তিক শিশু যত্ন কেন্দ্র, শিশুদের সাঁতার শেখানোসহ অভিভাবকদের সচেতন করা হবে এবং প্রকল্পের প্রস্তাবিত কার্যক্রম শিশুদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আবেগিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সার্বিক বিবেচনায় প্রকল্পটি অনুমোদন করা যেতে পারে। প্রকল্পটি জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০২৪ মেয়াদে বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি।
/আরএ