কবিতার কারুঘরে শীত
রাকিবুল রকি
|
![]() বাংলা সাহিত্যে আদায় করে নিয়েছে তাদের আসন। অবশ্য এর অন্যথা হওয়ারও কারণ নেই। মানুষ প্রকৃতির পুত্র। প্রকৃতির বিরাট প্রভাব রয়েছে মানুষের মনে, কর্মে। ফলে সাহিত্যে মানুষের কথা আসলে প্রকৃতির কথা, প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের গাথা উঠে আসবেই। বর্ষপরিক্রমায় বাংলাদেশের পঞ্চম ঋতু শীত। পাশ্চাত্যে শীতের যে ভয়াবহ রূপ, এখানে অবশ্য ততটা নেই। তবু বলতে হয়, ছোট্ট এ ব-দ্বীপের মানুষের কাছে শীত ঠিকই সমীহ, ভালোবাসা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। প্রায় মধ্যযুগ থেকেই বাংলা সাহিত্যে শীতের উপস্থিতি টের পাই। বৈষ্ণব পদাবলিতে, মঙ্গলকাব্যে, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানে শীতের কথা চকিতে হলেও দেখা দিয়েছে। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে’ ফুল্লার বারো মাসের দুঃখের বর্ণনা দিতে গিয়ে শীতের কথাও বলেছেন। তিনি লিখেছেন- ‘কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ। যগজনে করে শীত-নিবারণ বাস॥ নিযুক্ত করিলা বিধি সভার কাপড়। অভাগী ফুল্লার পরে হরিণের ছড়॥ তবে আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে শীত রোমান্টিক আবহ নিয়ে উপস্থিত। শীতের হিমে দুটো শরীর কাছে আসে প্রেমের টানে। মেতে উঠে মৈথুনে। পরস্পর এতটাই প্রমত্ত হয়ে উঠে যে, শীতও পালিয়ে যায়। আলাওল লিখেছেন- ‘সহজে দম্পতি মাঝে শীতের সোহাগে। হেমকান্তি দুই অঙ্গ এক হৈয়া লাগে॥ অন্তরে না রহে হেম অঙ্গ রত্নহার। উরে উরে দুঁহু মনে হএ একাকার॥ দুই যৌবনের যুদ্ধ লাগএ যখনে। প্রাণ লৈয়া উড়ে শীত পালাএ তখনে॥’ রবীন্দ্রনাথের সুবিশাল কাব্যসম্ভারে শীত নানাভাবে উঠে এসেছে। তার কবিতা, গানে, কথাসাহিত্যে কখনও শীতের বর্ণনা এসেছে, কখনও শীতের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে অন্তর্গত দর্শন কিংবা কখনও শীত দেখা দিয়েছে প্রেমের উৎস হিসেবে। শীতের আগমনে প্রকৃতি রিক্ত হয়ে পড়ে। পাতা ঝরে পড়ে। আসে নানান পরিবর্তন। কিন্তু প্রকৃতির সেই রিক্ততাই গোপনে নিয়ে আসে নতুনের আগমনি বার্তা। কবি বলেছেন- ‘মাঘের সূর্য উত্তরায়ণে পার হয়ে এল চলি; তার পানে, হায়, শেষ চাওয়া চায় করুণ কুন্দকলি। উত্তরবায় একতারা তার তীব্র নিখাদে দিল ঝংকার, শিথিল যা ছিল তারে ঝরাইল, গেল তারে দলি দলি॥ শীতের রথের ঘূর্ণিধূলিতে গোধূলিরে করে ম্লান, তাহারি আড়ালে নবীন কালে কে আসিছে সে কি জানো। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি। ‘অভিশাপ’ কবিতায় দেখি অভিমানী এক প্রেমিককে। তিনি বলছেন- ‘আসবে আবার শীতের রাতি, আসবেনাক’ আর সে- তোমার সুখে পড়ত বাঁধা থাকলে যে-জন পার্শ্বে, আসবেনাক’ আর সে। শীতের রিক্ততা কখনও কখনও মানুষের নিঃসঙ্গতা জাগিয়ে তোলে। মনে করিয়ে দেয় অতীতে হারিয়ে অনেকের মুখ। যারা নেই, শীতের রাতে তারা জীবন্ত হয়ে স্মৃতির পটে! জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন- ‘এখন শীতের রাতে অনুপম ত্রিবেদীর মুখ জেগে ওঠে। যদিও সে নেই আজ পৃথিবীর বড়ো গোল পেটের ভিতরে সশরীরে; টেবিলের অন্ধকারে তবু এই শীতের স্তব্ধতা এক পৃথিবীর মৃত জীবিতের ভিড়ে সেই স্মরণীয় মানুষের কথা হৃদয়ে জাগায়ে যায়;’ শীতের আগমনে প্রকৃতি বদলে যায়। বৃক্ষপাতা শূন্য হয়ে পড়ে। সাপ চলে যায় দীর্ঘ ঘুমে। তারপর শীত শেষে আবার জেগে ওঠে নতুন করে। বুদ্ধদেব বসু শীতে তেমনি মরে যাওয়ার আকাক্সক্ষা করেছেন। কেননা তাতে তিলে তিলে মরে যাওয়ার যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচা যায়। তাই লিখেছেন- ‘আমি যদি ম’রে যেতে পারতুম এই শীতে, গাছ যেমন ম’রে যায়, সাপ যেমন ম’রে থাকে সমস্ত দীর্ঘ শীত ভ’রে। হেমন্তে ফসল তোলা হয়ে গেলেও দরিদ্রের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। ফসল তোলার পর যে সুখচিত্র একদিন বাংলার ঘরে ঘরে ছিল, আজ সেই অবস্থা আর নেই। নানা কারণেই মানুষ শহরে ছুটে যাচ্ছে। তেমনি এক চিত্র দেখি বিষ্ণু দে-র কবিতায়- ‘দু-চোখ ছায় বাংলা দেশের মাটি নদী ও খাল খামার তেপান্তর পৌষমাসে বাঁধি সোনার আঁটি অনেক পরব, দেশ যে উর্বর। তবুও কোন মরিয়া পথভুলে এসেছি সব কলকাতার পথে?’ (এক পৌষের শীত) শীতের সকাল ঢাকে কুয়াশার চাদরে। দীর্ঘরাতের ক্লান্তি ঝেড়ে জেগে ওঠে প্রকৃতি। পাখি। ঘাসের আলজিহ্বায় জমে থাকে টলোমলো শিশির। শিশিরস্নাত ভোরের ছবি আঁকতে গিয়ে আহসান হাবীব লিখেছেন- ‘রাত্রিশেষ। কুয়াশার ক্লান্তমুখ শীতের সকাল- পাতার ঝরোকা খুলে ডানা ঝাড়ে ক্লান্ত হরিয়াল। শিশির সন্নত ঘাসে মুখ রেখে শেষের কান্নায় দুচোখ ঝরেছে কার, পরিচিত পাখিদের পায় চিহ্ন তার মোছেনি এখনো, আছে এখনো উজ্জ্বল- কান্নায় মাধুরীটুকু ঘাসে করে টলোমল।’ (শীতের সকাল) শীত কখনও কখনও উপমা হয়ে ধরা দিয়েছে কবিতার শরীরে। শামসুর রাহমান শয্যাশায়ী রোগীর অবস্থা বোঝাতে শীতের শুকিয়ে যাওয়া নদীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি যখন লেখেন- ‘শুয়ে আছে একজন নিরিবিলি ভোরের শয্যায় শীত-গোধূলির শীর্ণ শব্দহীন নদীর মতন শিথিল শরীর তার লেগে আছে ফ্যাকাশে চাদরে, দেয়ালে আলোর পরী।’ তখন আমাদের চোখেও ভেসে ওঠে জীবনপ্রদীপ নিভে আসা কোনো মানুষের প্রতিকৃতি। শীত যেমন সবকিছু রিক্ত করে, তেমনি এক মায়া জাগিয়ে তোলে প্রকৃতির কোলে। কোমলতায় ভরে ওঠে চারদিক। রোদে তেমন তীব্রতা থাকে না। সবখানেই যেন অলসতা, শিথিলতা। তেমনি মায়াময় এক প্রকৃতির ছবি এঁকেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়- ‘মায়ামমতার মতো এখন শীতের রোদ মাঠে শুয়ে আছে আর কেউ নেই ওরা সব ফিরে গেছে ঘরে দু’একটা নিবারকণা খুঁটে খায় শালিকের ঝাঁক ওপরে টহল দেয় গাংচিল, যেন প্রকৃতির কোতোয়াল।’ শীত একেক মানুষের কাছে একেক রকম আবেদন নিয়ে আসে। ধনীর জন্য এই শীত যেমন উপভোগের। তেমনি দরিদ্রের জন্য পরম পরীক্ষার। এ জন্যই বাংলায় একটি প্রবাদপ্রচলিত রয়েছে ‘কারো পৌষমাস, কারো সর্বনাশ’। এই কথাটিকে ভেঙে বিনয় মজুমদার দিয়েছেন নতুন দ্যোতনা। ব্যঞ্জনা। একজন যথার্থ কবির কাজই এটি। পুরনো মিথ, প্রচলিত প্রবাদকে ভেঙে নতুন অর্থ দান করা। বিনয় মজুমদারের ‘এক পঙ্ক্তির কবিতা’ গ্রন্থে এক পঙ্ক্তির একটি কবিতা হলো, ‘মানুষের পৌষমাস মাছে সর্বনাশ’। এখানে বুঝতে সমস্যা হয় না, শীত কোনো কোনো মানুষের জন্য উপভোগের হলেও, সব মাছের জন্যই তা ক্ষতিকর। কেননা শীত মানেই নদীর মরে যাওয়া। মাছের বাসস্থান সঙ্কুুচিত হয়ে আসা। শীতের সঙ্গে বরফ পড়ার সম্পর্ক থাকলেও বাঙালি জীবনে তা দূরান্বয়ী। তাই কোনো বাঙালি যখন শীতপ্রধান দেশে গিয়ে বরফ ঝরতে দেখে, স্বভাবতই আনন্দে আহ্লাদিত হয়ে পড়েন। নির্মলেন্দু গুণ বরফ পড়ার দৃশ্যে আনন্দানুভূতি প্রকাশ করেছেন এভাবে- ‘খুলে দাও বরফের আলপনা আঁকা হোটেলের সমস্ত জানালা, খুলে দাও আমার পোশাক। আমাকে আবৃত করে আজ শুধু বরফ ঝরুক সারাদিন। আমি আজ কোথাও যাবো না, আজ শুরু বরফের সাথে খেলা।’ এ কথা না বললেও চলে শীত বাংলা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। রসনাবিলাসী বাঙালির জীবনের খেজুরের রস, খেজুরের রসের পায়েস, পিঠাপুলি খাবারের সময় এই ঋতু। হেমন্তের ওঠা ফসল শীতেই বাঙালির ঘরে ঘরে ছড়ায় আনন্দের দীপ্তি। এই সময় মেয়েরা শ^শুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে নায়র আসে। মেয়ের আগমন উপলক্ষে চলে কত রান্নাবান্না। যদিও এখন অনেকটাই বদলে গেছে সেসব আচার-অনুষ্ঠান। হয়তোবা ধুঁকে ধুঁকে আজো কোনো পল্লীর ঘরে টিকে আছে। তবে সংস্কৃতি ধীরে ধীরে বদলে গেলেও সেসব দিনের কথা এখনও জেগে আছে কিছুটা পুরনো হয়ে আসা প্রজন্মের স্মৃতিতে। /আরএ
|