গুজব মোকাবিলায় প্রস্তুতি কতটুকু
এস এম আমানূর রহমান
|
![]() সম্প্রতি আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে নিয়ে ছড়ানো গুজবে নতুন করে আলোচনায় আসে বিষয়টি। এই গুজবে বলা হয়, ‘সরকারের আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, তাকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ এর পাশাপাশি ফেসবুকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ছবিগুলো প্রতিমন্ত্রী শেয়ার করেছেন তাকে ‘অতীতে তোলা ছবি’ বলেও এই গুজবে প্রচার করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে বেসরকারি ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠানগুলো জানায়, জুনাইদ আহমেদ পলক যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেছেন এবং সেখান থেকে চলতি বছরে তিনি ছবিগুলো তুলেছেন। ২০২০ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যাননি। নিজেকে নিয়ে এ ধরনের গুজবে মর্মাহত হয়েছেন বলে গণমাধ্যমে জানান আইসিটি প্রতিমন্ত্রী। কিন্তু যখন দেশের আইসিটি প্রতিমন্ত্রীকে নিয়ে এ ধরনের গুজব তৈরি হয় এবং মানুষ তা বিশ্বাস করে, তখন গুজব নিয়ে সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে তৈরি হয় প্রশ্ন। গুজব প্রতিরোধে বিটিআরসি, আইসিটি মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে রয়েছে একটি গুজব প্রতিরোধ কমিটি। এ ছাড়া তথ্য অধিদফতর সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে পৃথক আরেকটি দল নিয়ে কাজ করছে যারা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত ভুল তথ্য বা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তা মোকাীবলায় সমন্বয়ের মাধ্যমে সঠিক তথ্য সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু তারপরও মোকাবিলা করা যাচ্ছে না গুজব, কেন? এ বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্য অধিদফতরের সাবেক প্রধান কর্মকর্তা সুরথ কুমার সরকার বলেন, আপনি যদি বলেন, গুজব মোকাবিলা করা যাচ্ছে না, তা হলে আপনার সঙ্গে একমত হওয়ার সুযোগ নেই। কেন না অতীতের তুলনায় এখন আরও দ্রুত গুজব বা ভুল তথ্য বাছাই করে সঠিক তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে সরকার। গুজব প্রতিরোধে পৃথক কমিটিও রয়েছে। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো গুজব আমাদের দেশের জন্যও সমস্যা। জনসংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে এখানে গুজব মোকাবিলার বিষয়টি একটু কঠিন। আসলে কতটা কঠিন গুজব মোকাবিলা? বাংলাদেশে ফেসবুক অনুমোদিত ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান ‘ফ্যাক্টওয়াচ’-এ কর্মরত ফ্যাক্ট চেকার আপন দাস বলেন, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে শীর্ষ ১০-এ রয়েছে বাংলাদেশ। এই দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা অধিকাংশই কিশোর-তরুণ। আর এ ছাড়া এদের অনেকেই স্বল্পশিক্ষিত। মূলত তারা যেন গুজবের ফাঁদে পা না দেয়, সে জন্যই আমরা কাজ করি। কিন্তু সবকিছু যে আমরা দেখছি এবং তার ফ্যাক্ট চেক করছি তা কিন্তু নয়। বরং পাবলিক ডোমেইনে যা কিছু আছে, শুধু সেগুলো আমরা ফ্যাক্ট চেক করছি। কিন্তু এর বাইরেও প্রাইভেট গ্রুপ এবং এমন আরও অসংখ্য স্থান রয়েছে যে ক্ষেত্রে ফ্যাক্ট চেক করা সর্বদা সম্ভব হচ্ছে না। আর সেনসিটিভ বেশ কিছু ইস্যু রয়েছে যেগুলো আমরা ফ্যাক্ট চেক করি না। কেননা এগুলোর ফ্যাক্ট চেক করে সত্য-মিথ্যা বলার কিছু নেই। এগুলো আসলে নৈতিক বিষয়। যেখানে শতভাগ সত্য বা শতভাগ মিথ্যা বলে কিছু নেই। কিন্তু নৈতিক অবস্থান থেকে বিষয়গুলো শেয়ার দেওয়া উচিত নয়। সরকার বর্তমান সময়ে গুজব মোকাবিলায় যথেষ্ট সফল দাবি করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, একসময় মানুষের মুখে মুখে গুজব ছড়িয়ে যেত। কিন্তু এখন যেহেতু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসার হয়েছে তাই এটিকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে গুজবের জন্য। বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গেই গুজবের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু। যারা এদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তারা বাংলাদেশ জন্মের আগে থেকেই গুজব ছড়ানো শুরু করে। আজও তারা গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে। যারা বাংলাদেশের অস্তিত্ব কখনও মেনে নিতে পারেনি তারা যখন যেখানে থেকেছে সেখান থেকেই গুজব ছড়িয়েছে। এখনও দেশ-বিদেশ থেকে তারা গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণেই গুজব মোকাবিলায় এই রাষ্ট্রের যা যা সম্ভব সকলভাবেই কাজ করা হচ্ছে। ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের অন্যতম কারণ ছিল এই গুজব ও তথ্য সন্ত্রাস মোকাবিলা। বিটিআরসির বিষয়ে আমি বলতে পারব, রাষ্ট্রবিরোধী এ ধরনের প্রচেষ্টা মোকাবিলায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের পক্ষে যেটুকু সম্ভব, বিশেষত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যতটুকু ক্ষমতা বিটিআরসিকে দেওয়া হয়েছে, সেই দায়িত্ব তারা পালন করছে। এ ধরনের অপপ্রচার যখন কোনো ওয়েবসাইট থেকে করা হয়, তখন সরাসরি সেই ওয়েবসাইটটি আমরা বন্ধ করতে পারি। সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করি, তাদের কাছে রিপোর্ট করি এবং সে অনুসারে যতটুকু প্রতিহত করা সম্ভব ততটুকু প্রতিহত করি। সম্পূর্ণ সফল হই তা নয়। কেন না এসব সোশ্যাল মিডিয়াগুলো যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হচ্ছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের দেশের সমস্যাগুলো ঠিকমতো বোঝে না। কেন না আমাদের দেশের মতো সঙ্কট তাদের দেশে তারা দেখেনি। সে কারণে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে কয়েক বছর আগেও যেমন ছিল তার তুলনায় অনেক বেশি উন্নতি করেছি আমরা। শুধু বিটিআরসি নয়, বিষয়টি নিয়ে পৃথকভাবে কাজ করছে তথ্য মন্ত্রণালয় ও তথ্য অধিদফতর। এ বিষয়ে তথ্য অধিদফতরের প্রধান কর্মকর্তা মো. শাহেনুর মিয়া বলেন, ‘আমাদের দুটো কমিটি আছে। একটি কমিটির প্রধান তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। এর সঙ্গে তথ্য অধিদফতর বিভিন্ন এজেন্সিসহ বিটিআরসি, বিটিসিএল রয়েছে। এ ছাড়া তথ্য অধিদফতরেরও গুজব প্রতিরোধে একটি কমিটি রয়েছে। এর কাজ আবার একেবারেই ভিন্ন। এই কমিটিতে মূলত আমাদের যোগাযোগ কর্মকর্তারা (পিআরও) যে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে, তাদের মন্ত্রণালয়ে গুজব সংক্রান্ত যে বিষয়গুলো তারা খুঁজে পায়, সেগুলোর একটা প্রতিবেদন তারা প্রদান করে এবং এই গুজব মোকাবিলায় কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে সে বিষয়ক পরামর্শ চাওয়া হয় এবং সেক্ষেত্রে এ বিষয়ে গুজব প্রতিরোধের জন্য আমরা গণমাধ্যমের কাছে নোট পাঠাই এবং জানাই যে এ বিষয়গুলো গুজব, যার কোনো ভিত্তি নেই। তবে তথ্য প্রতিমন্ত্রীকে নিয়ে ছড়ানো গুজব নিয়ে এখনও কোনো প্রেস নোট প্রদান করা হয়নি বলে জানান তিনি। এই গুজব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দ্রুত প্রকাশ করা হবে, জানান এই তথ্য কর্মকর্তা। তবে গুজব মোকাবিলার বিষয়টি যথেষ্ট কঠিন বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি। প্রধান তথ্য কর্মকর্তা বলেন, এই গুজবের শেকড় অনেক গভীরে। কিছু গুজব দেশে থেকে হচ্ছে কিছু গুজব দেশের বাইরে থেকে। দেশের বাইরে থেকে যে গুজবগুলো হচ্ছে সেক্ষেত্রে কিছুই করতে পারছে না বাংলাদেশ সরকার। কেননা এর ডোমেইনগুলো বাইরে। দেশের অভ্যন্তরের ডোমেইনগুলোর বিরুদ্ধে দ্রæত আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। কিন্তু ইউটিউব বা ফেসবুকে যেই গুজব ছড়ানো হয় দেশের বাইরে থেকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ বাংলাদেশ সরকারের নেই। আর এমন বিষয় নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের বেশ কষ্ট করতে হয়। তবে মো. শাহেনুর আশাবাদ ব্যক্ত করেন বলেন, সম্প্রতি ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার করে ভুল সংবাদ ও গুজবকে বাছাই করছে এবং অ্যাকাউন্ট বা প্রোফাইল ব্যান (বন্ধ) করে দিচ্ছে। আসলে বিশ্বে সবাই এখন এই ভুল তথ্যের প্রবাহ বন্ধে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে ফেসবুকের স্থানীয় যেই প্রতিনিধি রয়েছেন তাকে ডেকে নিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করাসহ আরও অনেক পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারও ভাবছে। আশা করছি, এই বিষয়গুলোর জন্যও কার্যকর সমাধান মিলবে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গুজব প্রতিহত কতটা সম্ভব নিয়ে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। তারা মনে করেন, সাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও গণপরিসরে গুজব বাছাইয়ে দক্ষতা তৈরির মাধ্যমেই কেবল গুজব প্রতিহত করা সম্ভব। আর এক্ষেত্রে স্কুল-কলেজেরে শিক্ষা কার্যক্রমে গুজব ও ভুল তথ্য বাছাইয়ের বিষয়ে পৃথক অধ্যায় সংযুক্তি ও সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের পক্ষে মত দিয়েছে তারা। ফ্যাক্ট চেকার আপন দাসের মতে, যেহেতু আমাদের কিশোর-তরুণদের বড় একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে। তাই তাদের যেকোনো তথ্য যাচাই করার পদ্ধতি সম্পর্কে জানানো এবং গুজবের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে গুজব প্রতিহত করা সম্ভব। গুজব প্রতিহত করা প্রসঙ্গে শিক্ষা কারিকুলামে নতুন করে কিছু সংযুক্ত হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) প্রফেসর মো. মশিউজ্জামান বলেন, বর্তমানে যেই বইগুলো রয়েছে তার অধিকাংশ অধ্যায় ২০১২ সালের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে আপডেট করা। নতুন করে এই কারিকুলাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং নতুন যেই বইগুলো আমাদের শিক্ষার্থীরা পাবে সেখানে শুধু তথ্য যাচাই এবং গুজব নিয়ে সচেতনতা নয়, বরং এর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের নৈতিক দিক এবং দায়িত্ব প্রসঙ্গে আরও বিস্তারিত আলোচনা থাকছে। পূর্বে এই বিষয়গুলো এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু এখন আমরা এর গুরুত্ব জানি। আর সে কারণেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য কারিকুলামে বিষয়গুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে সংযুক্ত করা হচ্ছে।
|