উজাড় হচ্ছে বন্যপ্রাণী, হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য
রূপম চক্রবর্ত্তী
|
![]() শিল্পায়নের কারণে বায়ুমণ্ডলে ব্যাপকভাবে বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়ম মোতাবেক কলকারখানা গড়ে না ওঠায় এ বিপত্তি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে পুরনো রুগ্ণ শিল্প-কারখানাগুলো আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে যেমন দূষণরোধী প্রযুক্তি গ্রহণ করতে পারছে না, তেমনি নতুন কারখানা গড়ার ক্ষেত্রে আইন-কানুন সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না। বিবেকহীন মানুষ নিজের সামান্য স্বার্থসিদ্ধির জন্য অরণ্য উচ্ছেদের নেশায় মেতে উঠেছে। অরণ্যের বিস্তার যত কমছে বন্যপ্রাণীরা ততই হারাচ্ছে তাদের খাদ্য ও বাসস্থানের অধিকার। জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বহু বিরল প্রজাতির প্রাণী। প্রকৃতির সঙ্গে পারস্পরিক নির্ভরশীলতামূলক সহাবস্থানের চিরাচরিত নীতি থেকে সরে এসে একতরফাভাবে নিজের প্রয়োজনে ইচ্ছেমতো মানুষ তাকে ব্যবহার করা শুরু করেছে। ফলে বন ও বন্যপ্রাণীদের ওপর শুরু হয়েছে যথেচ্ছাচার, অবারিত অনিয়ন্ত্রিত শোষণ। পৃথিবীতে প্রকৃতির ভারসাম্য তাই আজ দাঁড়িয়েছে সঙ্কটের মুখোমুখি। প্রকৃতিকে এই সঙ্কটের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারলে সভ্যতার টিকে থাকাও অসম্ভব। বনবিহীন বন্যপ্রাণীদের বংশবিস্তার থেকে শুরু করে স্বাভাবিক বিচরণের কোনো নিশ্চয়তা নেই। অথচ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় বন রক্ষা ভিন্ন অন্য কোনো বিকল্প নেই। সৃষ্টির আদিতে মানুষের পথচলা শুরু হয়েছিল গাছপালা এবং বন্য পশু-পাখিদের সঙ্গে। ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ নামক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ গোষ্ঠীর তথ্য মতে, আবাসস্থল ধ্বংস, বিশেষ করে বন উজাড়করণের ফলে ১৬০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণীর প্রায় অর্ধেক প্রজাতি হুমকির সম্মুখীন। পাখির মধ্যে লাল মাথাযুক্ত হাঁস ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে; অন্যদিকে কালো তিতির, লাল মাথাযুক্ত শকুন, ঈগল, পেঁচা ও সাদা ঈগল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। শুধু নগরায়ণের প্রয়োজনে নির্বিচারে একের পর এক অরণ্য কেটে সাফ করে দেওয়া হচ্ছে। চোরাচালানকারীদের কবলে পড়ে বিভিন্ন মূল্যবান গাছ অচিরেই ধ্বংস হয়ে গেছে। বন্যপ্রাণিকুলের ধ্বংসের পেছনে অরণ্য ধ্বংসের কারণ সম্ভবত সব থেকে বেশি। বন্যপ্রাণীরা তাদের খাদ্য এবং আশ্রয়ের জন্য বিশেষভাবে অরণ্যের ওপর নির্ভর করে থাকে। তা ছাড়া ব্যাপক পরিবেশ দূষণের ফলে বিভিন্ন পতঙ্গ বিলুপ্তির গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে অরণ্যের স্বাভাবিক বিস্তার পদ্ধতি ব্যাহত হচ্ছে। বন এবং বন্যপ্রাণী ধ্বংসের ব্যাপারে আলাদা করে আর কোনো আলোচনার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। বন-জঙ্গলের ওপর মানুষের যথেচ্ছাচারের কথা আজ সর্বজনবিদিত। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত আইনটি, ২০১২ সালের ১০ জুলাই রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে। উইকিপিডিয়ার মাধ্যমে আরও জানতে পারি আইনটি বাংলা ভাষায় রচিত। আইনের ৬ ধারা মোতাবেক এই আইনের তফসিলে উল্লিখিত বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী শিকার বা বন্যপ্রাণীর মাংস, ট্রফি, অসম্পূর্ণ ট্রফি, বন্যপ্রাণীর অংশবিশেষ অথবা এসব হতে উৎপন্ন দ্রব্য দান, বিক্রয় বা কোনো প্রকারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা অন্য কারও নিকট হস্তান্তর করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আইনের ৪১ ধারা মোতাবেক আরও উল্লেখ হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করলে বা উক্ত অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা প্রদান করে থাকলে এবং উক্ত সহায়তা বা প্ররোচনার ফলে অপরাধটি সংঘটিত হলে, উক্ত সহায়তাকারী বা প্ররোচনাকারী তাহার সহায়তা বা প্ররোচনা দ্বারা সংঘটিত অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। আইনের ৩৬ ও ৩৭ ধারায় বাঘ, হাতি, চিতাবাঘ ইত্যাদি সম্পর্কে বলা হয়েছে। আইনের ৩৬ ধারায় দণ্ড সর্বনিম্ন ২ বছর, সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড ও সর্বনিম্ন ১ লাখ, সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। সংরক্ষিত উদ্ভিদ সংক্রান্ত ৬নং ধারা লঙ্ঘন করলে ৩৯ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি এক বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং পুনরায় একই অপরাধ করলে শাস্তি দ্বিগুণ হবে। কথায় বলে চোর না শোনে ধর্মের কাহিনি। তবু আইনানুগ শাস্তির ভীতি দেখিয়ে হলেও দুর্বৃত্তদের সতর্ক ও সচেতন করতে হবে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও পরিকল্পিত অভিযান প্রয়োজন। আমাদের রয়েছে বিশে^র বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বনাঞ্চল এবং বয়ে চলা অসংখ্য নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক জলাশয়, যা নানা প্রজাতির পশু-পাখি ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। এদেশে ৩০-৩৫ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১২৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬৫০ প্রজাতির পাখি ও ১১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাসস্থল। মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও প্রাকৃতিক সম্পদের অতি আহরণের ফলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ক্রমশই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। আবাসস্থল ধ্বংস, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব এবং অপর্যাপ্ত সংরক্ষণ প্রয়াসের কারণে প্রায় অর্ধেকসংখ্যক বন্য প্রাণীই বিলুপ্তির হুমকিতে পড়েছে। বনাঞ্চল ধ্বংস করে ভারী শিল্প অবকাঠামো, কলকারখানা, জনবসতি, হাট-বাজার, বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাছের ঘের, রাস্তাঘাট গড়ে তোলার কারণে পরিবেশ দূষিত হয়ে বাঘের আবাসস্থল ক্রমেই তাদের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে বলেও তারা মনে করছেন। অপরিকল্পিত পর্যটনেরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাঘের ওপর। এক্ষেত্রে সুন্দরবনের ভেতরে জনসাধারণের প্রবেশ সীমিত করে আনতে হবে। ক্ষুদ্র থকে বৃহৎ প্রতিটি উদ্ভিদ ও প্রাণীর রয়েছে গুরুত্ব। নিজ নিজ বাস্তুসংস্থানে তারা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব ভূমিকায় অবতীর্ণ। দেশের মানুষকে বাঁচাতে প্রথমে বাঁচাতে হবে তার প্রকৃতিকে। আর এদেশের প্রকৃতিকে বাঁচাতে প্রথমেই গুরুত্ব দিতে হবে সুন্দরবনসহ সব বন্য পরিবেশকে, যার মাধ্যমে টিকে থাকবে অসংখ্য প্রাণী। এভাবেই রক্ষা হবে পরিবেশের ভারসাম্য। শুধু পরিবেশগত কারণেই না, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলেও এদেশের জীববৈচিত্র্যকে বাঁচাতে হবে। অসচেতনতা এবং নানাবিধ কারণে প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীবকুল। তাই তাকে বাঁচাতে নিতে হবে সঠিক আইনের পদক্ষেপ। বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। লেখক: চাকরিজীবী |