বিকল্প জ্বালানির খোঁজে বিশ্ব
নিজস্ব প্রতিবেদক
|
![]() বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি মধ্যে রাখার বিষয়ে সর্বশেষ জলবায়ু সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে তা পূরণের পূর্বশর্তই হলো বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার। অর্থাৎ জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধ করে অন্য কোনো জ্বালানির ব্যবহার করা। এ ক্ষেত্রে ইলেকট্রিক কার ও বাইক ব্যবহারের সম্ভাবনা বাড়লেও শেষপর্যন্ত অধিকাংশ গ্রাহক এটি ব্যবহার করছে না, কেননা এগুলো চার্জ হতে অনেক বেশি সময় নষ্ট হয়। তবে যাতায়াত ছাড়াও কলকারখানা পরিচালনায় ব্যবহৃত জ্বালানির বিকল্প কী হতে পারে তা নিয়েই মূলত দুশ্চিন্তা। এ ক্ষেত্রে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে ভাবা হচ্ছে হাইড্রোজেনভিত্তিক শক্তি উৎপাদক কেন্দ্রগুলোকে। হাইড্রোজেন জ্বালানি নবায়নযোগ্য ও সম্ভাবনাময় বিকল্প জ্বালানি। এটি পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী। পানিকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে হাইড্রোজেন উৎপাদনের প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চীনসহ আরও বেশ কিছু দেশ। বাংলাদেশেও এ বিষয়ে গবেষণা শুরু করেছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)। তারা আশাবাদী, অচিরেই হাইড্রোজেনভিত্তিক জ্বালানি উৎপাদন শুরু করবে তারা। এক কেজি হাইড্রোজেন থেকে ৩৩ দশমিক ৩৩ কি.জু./গ্যা এনার্জি পাওয়া যায়। যেখানে পেট্রোল, ডিজেল ও সিএনজি থেকে পাওয়া যায় যথাক্রমে ১২ কি.জু./গ্যা (প্রায়) ও ১৪ দশমিক ৭ কি.জু./গ্যা। হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল কার এক কেজি হাইড্রোজেন দিয়ে ১০০-১৩১ কিলোমিটার পথ চলতে পারে। যেখানে এক কেজি পেট্রোলে চলে ১৬ কিমি। ব্যবহার উপযোগী অবস্থার জন্য হাইড্রোজেন জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে উৎপাদন, ডেলিভারি ও বিতরণ খরচ বিবেচনায় নিতে হয়। বর্তমানে হাইড্রোজেনের ইউনিট মূল্য ৫ থেকে সাড়ে ৭ ডলার। ৯ লিটার পানির তড়িৎ বিশ্লেষণ থেকে ১ কেজি হাইড্রোজেন ও ৮ কেজি অক্সিজেন পাওয়া যায়। এর উৎপাদন খরচ অপারেশন টাইমের ভিত্তিতে ১ দশমিক ৬ থেকে ১০ ডলার। অন্যদিকে বায়োমাস গ্যাসিফিকেশনের মাধ্যমে উৎপাদিত পাইপলাইন উপযোগী হাইড্রোজেনের মূল্য আড়াই থেকে সাড়ে তিন ডলার। এক কেজি বায়োমাস থেকে শূন্য দশমিক ৮ থেকে শূন্য দশমিক ১৩ কেজি হাইড্রোজেন পাওয়া যায়। তবে হাইড্রোজেনের আরও ব্যাপক প্রয়োগ করতে হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমপক্ষে দুইগুণ বাড়াতে হবে। সেই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে আমাদের বায়ু ও সৌরশক্তি থেকে জ্বালানি উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়াতে হবে। তবেই পরিবহনের ক্ষেত্রে হাইড্রোজেন এবং মানুষের জন্য যথেষ্ট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির সরবরাহ ব্যাপক আকারে বাড়িয়ে হাইড্রোজেন উৎপাদন সম্ভব নয়। কিন্তু সেই জ্বালানি ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে ফুয়েল স্টেশনের মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবও তো বড় এক সমস্যা। সেই সঙ্গে পানিকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে হাইড্রোজেন পাওয়ার প্লান্ট তৈরির সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে ভাবছে না অনেক দেশ। হাইড্রোজেন পাওয়ার প্ল্যান্টের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চীনের ইয়ারলাং সাংপো নদী চীন, ভারত এবং বাংলাদেশের একটি বড় অংশের জনগোষ্ঠীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ হাজার মিটার উঁচু তিব্বতের চেমায়ুংডং হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে এটি তিব্বত থেকে সিয়াং নামে প্রবেশ করেছে ভারতের অরুণাচলে। এরপর আসামে প্রবেশ করেছে নদীটি যেখানে তার নাম ব্রহ্মপুত্র। এরপর নদীটি প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে যা যমুনা নদী নামে পরিচিত। চীন বিগত কয়েক বছর ধরেই ইয়ারলাং সাংপোতে বাঁধ তৈরি করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বড় একটি বাঁধ জাংমু হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট যা ২০১৫ সাল থেকে কাজ শুরু করে। কিন্তু এই বাঁধের কার্যক্রম শুরুর কয়েক বছর পর থেকেই অরুণাচল অঞ্চলে হঠাৎ করেই নদীর পানি অতিরিক্ত ঘোলা এবং কালো রঙ ধারণ করে যা ব্যবহারের উপযোগিতা হারায়। চীনের ১৪তম পঞ্চবর্ষ পরিকল্পনায় দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত হাইড্রোপাওয়ার প্রতিষ্ঠান ‘পাওয়ার চায়না’ তিব্বতের অটোনমাস অঞ্চলের সঙ্গে একটি বড় হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট তৈরির চুক্তি স্বাক্ষর করে যা ইয়ারলং সাংপো নদী তীরে গড়ে তোলা হবে। এই নদীর জলরাশির গতিপথে লাগাম টেনে উত্তরে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছে চীন, যা বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। এই অঞ্চলে কৃত্রিম এই পরিবর্তনের ফলে ভূমিকম্প ও ভূমিধসের পরিমাণ অনেকাংশ বাড়বে। যেমনটি ২০২০ সালে তিব্বতের চেন এলাকায় হওয়া ভূমিধস বা নিনচি অঞ্চলে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল, এমন ঘটনা নিয়মিত ঘটতে পারে। ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে চীনের যেই লক্ষ্য রয়েছে তা অর্জনে ইয়ারলং সাংপো নদীতীরে গড়ে ওঠা এই প্রজেক্ট বড় ভূমিকা রাখবে বলে বর্ণনা করছে দেশটি। এর মাধ্যমে ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে চায় চীন। সেই সঙ্গে এই প্রকল্পের মাধ্যমে তিব্বতে চাকরির বড় একটি বাজার তৈরি হবে বলেও প্রচার করছে দেশটি। ইয়ারলাং সাংপো নদী থেকে চীনের উত্তর প্রদেশে বড় অংশের পানি সরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে এই প্রকল্পের কাজটি করা হবে। সেই সঙ্গে এই প্রকল্পকে চীন তার জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবেও দেখছে, যার মাধ্যমে নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে আরও উন্নত হবে দেশটি। যখন জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে গ্রিন এনার্জিতে রূপান্তর করবে পৃথিবী, তখন কম খরচে জ্বালানি উৎপাদনের সহজ একটি পথ তৈরি করছে চীন। কিন্তু তাদের পরিবেশ রক্ষার এই উদ্যোগে মানব ও পরিবেশের জন্য যে বড় হুমকি হয়ে আসছে অন্য দুই দেশের জন্য সে বিষয়ে কিছুই বলছে না চীন। হাইড্রোজেনের আন্তর্জাতিক বাজার এবং সেটি কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম পণ্য উৎপাদনও বেড়ে চলছে। এর ফলে হাইড্রোজেন প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে আগামী ১০ বছরের মধ্যে এই জ্বালানি কাজে লাগিয়ে বিশ^জুড়ে আরও নতুন শক্তি উৎপাদন প্লান্ট, যানবাহনের জ্বালানি, ফিলিং স্টেশনসহ আরও অনেক কিছু তৈরির চিন্তা করা হচ্ছে। কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানির ভবিষ্যৎ না ভেবে যাচ্ছেতাই ব্যবহারের কারণে আজ যেই জলবায়ু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি আমরা। হাইড্রোজেন জ্বালানি ব্যবহার শুরুর আগে সুদূরপ্রসারী সেই পরিকল্পনা না করলে প্রকৃতি সুরক্ষার বদলে নতুন প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখবে বিশ্ব।
|