অধীনস্থদের প্রতি সদাচরণের নির্দেশ ইসলামে
মুশফিকুর রহমান
|
![]() একটি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনে বহু মানুষ একত্রে কাজ করেন। কেউ থাকেন প্রধান আর কেউ থাকেন অধীন। কেউ মালিক, কেউ কর্মচারী। উভয় প্রকার মানুষের সঙ্গে সুন্দর ও সম্মানজনক ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। কিন্তু অধিকাংশ সময় দেখা যায়, অধীনস্থ লোকদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেন মালিকরা। অফিসের কর্মচারী কিংবা বাসার কাজের লোক- সবার প্রতিই করা হয় অবিচার-অত্যাচার। বিশেষ করে শিশু ছেলেমেয়েদের ওপর চলে অকথ্য ও অমানবিক নির্যাতন। অতিতুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীর হাতে উত্তপ্ত খুন্তি দিয়ে শরীরে সেঁকা দেওয়ার ঘটনাও প্রকাশিত হয় পত্রিকার পাতায়। এমনকি নিষ্ঠুরতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে মেরে ফেলার মতো রেকর্ডও শোনা যায় কোথাও কোথাও। অথচ রাসুল (সা.)-এর আদর্শ হলো, কাজের লোকদের সঙ্গে অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ ও মানবিক আচরণ করা। তারা বড় ধরনের কোনো ভুল করে বসলে মমতার সঙ্গে সতর্ক করে শুধরে দিতে হবে আর ছোট ভুল প্রকাশ পেলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। বিখ্যাত সাহাবি হজরত আনাস বিন মালেক (রা.) দীর্ঘ ১০ বছর রাসুল (সা.)-এর ঘরের ও বাইরের নানা কাজ করেছেন। তার সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর আচরণ কেমন ছিল সে বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মদিনায় ১০ বছর রাসুল (সা.)-এর খেদমত করেছি। আমি ছিলাম অল্পবয়স্ক বালক। আমার সব কাজ রাসুলের মর্জিমাফিক হতো না। কিন্তু এই দীর্ঘ সময় তিনি কখনও আমাকে ধমক দেননি এবং বলেননি যে, এটা কেন করেছ বা এটা কেন করোনি?’ (আবু দাউদ : ৪৭৭৪) অনেক সময় দেখা যায়, কাজের লোকদের অত্যন্ত নিচু দৃষ্টিতে দেখা হয়। নিজেদের আহারপর্ব শেষে খাবারের অবশিষ্টাংশ এদেরকে খেতে দেওয়া হয় বা বাজার থেকে সরবরাহকৃত উন্নতমানের খাবার পরিবেশিত হয় মালিকপক্ষের দস্তরখানে আর বেচারি কাজের মেয়ের জন্য বরাদ্দ থাকে অনুন্নত দায়সারা গোছের কিছুর ব্যবস্থা। পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজ সন্তানের জন্য শহরের অত্যাধুনিক শপিংমল থেকে কেনা হয় নামিদামি ব্র্যান্ডের পোশাক, ঠিক সন্তানের বয়সি কাজের মেয়েটি বা ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় ফুটপাথ থেকে কিনে আনা পুরনো ও ব্যবহৃত কাপড়ের সেট। অথচ ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, তাদেরকেও নিজেদের মানের খাবার ও পোশাক প্রদান করা। হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করেছেন। অতএব তোমরা যা খাও তাদেরকেও তা খাওয়াও আর তোমরা যা পর তাদেরকেও তা পরিধান করাও। তাদেরকে সাধ্যাতীত কোনো কাজের আদেশ করো না। যদি করেই থাকো তবে তাদেরকে সহযোগিতা করো।’ (বুখারি : ২৫৪৫; মুসলিম : ১৬৬১)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন তোমাদের কারও সামনে তার সেবক খাবার পরিবেশন করে, তখন সে যদি সেবককে সঙ্গে বসাতে না পারে তা হলে এক লোকমা বা দুই লোকমা যেন তার হাতে তুলে দেয়। কেননা খাবার তৈরির কষ্টক্লেশ সে-ই সহ্য করেছে।’ (বুখারি : ২৫৫৭; মুসলিম : ১৬৬৩)। মানুষের সম্মান কোনো বর্ণ-গোত্র দ্বারা নির্ধারিত হবে না। বরং আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা বা তাকওয়া নির্ধারণ করবে ব্যক্তির মর্যাদা। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান হলো যারা তাকে ভয় করে।’ (সুরা হুজরাত : ১৩)। এ সমাজে মর্যাদার সঙ্গে বাস এবং জানমালের হেফাজতের হচ্ছে একজন মানুষের সামাজিক অধিকার। ইসলাম কাউকে কারও মর্যাদা হরণ ও অন্যায়ভাবে হত্যার অনুমোদন দেয় না। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা যেন সব মানুষকে হত্যা করার শামিল। হাদিসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর বিশ্বাস রাখে সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। এমনকি যুদ্ধের সময় বিরোধীপক্ষের নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গেও ভালো আচরণের কথা বলা হয়েছে। কাজের লোকরাও আমাদের মতোই মানুষ। তাই তাদের মানবীয় দুর্বলতাগুলো মেনে নেওয়া উচিত ও ভুল হয়ে গেলে ক্ষমা করা উচিত। একবার এক সাহাবি এসে রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি আমার কাজের লোককে কতবার ক্ষমা করব? রাসুল (সা.) চুপ থাকলেন। সাহাবি আবার জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর রাসুল (সা.) বললেন, ‘প্রতিদিন সত্তরবার।’ (তিরমিজি : ১৯৪৯)। অধীনস্থ লোকদের সঙ্গে আমাদের আচরণ যদি রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুযায়ী ভালোবাসার আচরণ হয়, তা হলে এদের মুখে হাসি ফুটবে। আর এদের খুশিতে হেসে উঠবে আমাদের সমাজ ও চারপাশ। |