ফোন দিলে বলা হচ্ছে- পরবর্তী প্রশিক্ষণ কিংবা পর্যালোচনার জন্য আপনার কল রেকর্ড করা হতে পারে। কিন্তু কিসের প্রশিক্ষণ বা পর্যালোচনার জন্য রেকর্ড করা হচ্ছে- এ বিষয়ে তেমন কোনো ধারণা নেই গ্রাহক কিংবা সেবাগ্রহীতার। এই রেকর্ডে গ্রাহকের কোনো সম্মতি আছে কি না সে বিষয়ে কোনো মতামত নেওয়া হয় না, এমনকি রাখা হয়নি কোনো বিকল্প ব্যবস্থা।
টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কল সেন্টারগুলোতেও দেখা যায় বেআইনিভাবে কল রেকর্ডের মহোৎসব। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, অনুমতি ছাড়া প্রতিষ্ঠানের পর্যালোচনা কিংবা প্রশিক্ষণের জন্য একজন গ্রাহকের ভয়েস কল রেকর্ড করা কতটা যৌক্তিক? অজান্তেই গ্রাহকরা নিজেদের গোপনীয়তা হারাচ্ছে না তো? প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন আচরণে বিব্রত গ্রাহকরা। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক ও সেলিব্রেটি কেউ বাদ যাননি কল রেকর্ড ফাঁসের হয়রানি থেকে। বিভিন্ন সময় কল রেকর্ড ফাঁস হওয়া এমন কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা এ বিষয়ে কথা বলতে অসম্মতি জানান। সামাজিকভাবে মর্যাদাহানি, পরবর্তী হয়রানি ও লোকলজ্জার ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।
গ্রাহকদের অভিযোগ, কিসের প্রশিক্ষণ বা অনুসন্ধানের জন্য এই রেকর্ড করা হচ্ছে সেটি স্পষ্ট নয়। অনুমতি ছাড়া এ ধরনের রেকর্ড অন্যায়, প্রতিষ্ঠানগুলো একতরফাভাবে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রাহকের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কোনো প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানের হেলপলাইনে ফোন করলে শুরুতেই কয়েক মিনিট ধরে কিছু রেকর্ড নির্দেশনা দেওয়া হয়। যেমন- অফার পেতে ১ চাপুন, কথা বলতে শূন্য চাপুন ইত্যাদি। এরপর বলা হয়, আপনার কলটি কাস্টমার ম্যানেজারের কাছে ট্রান্সফার করা হচ্ছে, দয়া করে অপেক্ষা করুন। ভবিষ্যৎ অনুসন্ধান, প্রশিক্ষণ ও পর্যালোচনার জন্য আপনার কলটি রেকর্ড করা হবে। চার্জ প্রযোজ্য।
শুধু টেলিকমই নয়, রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, হাসপাতাল, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখন এ নিয়ম অনুসরণ করছে।
গ্রামীণফোন থেকে ১২১-এ ফোন করা হলে বলা হয়, ‘৬৭ পয়সা প্রতি মিনিট, কাস্টমার ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে ৭ চাপুন।’ এরপর বলা হয়, ‘অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন, আপনার কলটি সাহায্যের জন্য ট্রান্সফার করা হচ্ছে।’ এরপর আবার বলা হয়, ‘প্রিয় গ্রাহক আপনার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, আপনার কলটি প্রশিক্ষণের জন্য রেকর্ড করা হতে পারে।’ এরপর নওশাদ নামে একজন কাস্টমার ম্যানেজার ফোন রিসিভ করে কথা বলেন। কলটি রেকর্ড হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি ভবিষ্যৎ প্রশিক্ষণ ও অনুসন্ধানের জন্য রেকর্ড করা হচ্ছে।’ শুধু গ্রামীণফোনই নয়, রবি, এয়ারটেল, বাংলালিংক ও টেলিটকসহ সব প্রতিষ্ঠান একই কাজ করছে।
রবি আজিয়াটা লিমিটেডের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম সময়ের আলোকে বলেন, কল সেন্টারগুলো কল কোয়ালিটি মেনটেইন, কাস্টমারের অভিযোগ ডিল করার জন্য কলটি রেকর্ড করা হয়ে থাকে। কাস্টমারের সম্মতি নেওয়ার অপশন কোথাও থাকে না। ইউরোপের কোনো কাস্টমার কেয়ারে ফোন করলেও একই কথা বলবে। কোনো কল রেকর্ড ফাঁস করায় আমাদের কোনো স্বার্থ নেই। সাধারণত যেগুলো হয় সেগুলো অপর প্রান্ত থেকে রেকর্ড করা হয়। আমাদের রেকর্ডগুলো যেভাবে করা হয় তাতে কপি করার কোনো সুযোগ নেই। সব কল রেকর্ড করা হয় না, কাস্টমারের অভিযোগ থাকলে সেটি রেকর্ড করা হয়। এটা আমাদের ইন্টারনাল অ্যানালাইসিসের জন্য ব্যবহার করা হয়। রেগুলেটরি রুলস অনুযায়ী আমরা ৬ মাস পর্যন্ত রেকর্ড সংরক্ষণ করি। ৬ মাস পর অটোমেটিক ডিলিট হয়ে যায়।
রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাওয়ের হেলপলাইন নম্বর ০৯৬৭৮১০০৮০০-এ ফোন করলে বলা হয়, ‘ভবিষ্যৎ অনুসন্ধানের জন্য আপনার কলটি রেকর্ড করা হবে।’ একই কথা বলছে রাইড শেয়ারিংয়ের আরেক প্রতিষ্ঠান ‘ও ভাই’। তাদের হেলপলাইন নম্বর ০৯৬১০০৫৬৭৮৯-এ ফোন করলে বলা হয়, ‘পরবর্তী প্রশিক্ষণের জন্য আপনার কলটি রেকর্ড করা হচ্ছে।’ যোগাযোগ করেও এ বিষয়ে পাঠাওয়ের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ইসলামী ব্যাংকের হেলপলাইন নম্বর ১৬২৫৯-এ ফোন করা হলে বলা হয়, ‘প্রিয় গ্রাহক, আপনার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য আপনার কলটি রেকর্ড করা হতে পারে।’
মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশের হেলপলাইন ১৬২৪৭ নম্বরে ফোন দিলে সেবা পেতে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। বলা হয়, ‘আপনার কলটি কাস্টমার সার্ভিস প্রতিনিধির কাছে ট্রান্সফার করা হচ্ছে অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন।’ এরপর বলা হয়, ‘ভবিষ্যৎ প্রয়োজন ও সেবার মান নিশ্চিত করার জন্য আপনার কলটি রেকর্ড অথবা মনিটর করা হতে পারে।’
বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন্স শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম সময়ের আলোকে বলেন, গ্রাহকের অভিযোগ থাকলে কলটি রেকর্ড করা হয়। এ ছাড়া কাস্টমার সেন্টারের কর্মকর্তারা ঠিকমতো তাদের দায়িত্ব পালন করছেন কি না সেটি পর্যবেক্ষণের জন্যও রেকর্ড করা হয়। এটা সম্পূর্ণ ইন্টারনাল বিষয়। তবে আমাদের এখান থেকে কল রেকর্ড ফাঁস হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
নগদের হেলপলাইন ১৬১৬৭ নম্বরে ফোন করা হলে জানানো হয়, ‘কারিগরি মানোন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের জন্য আপনার কলটি রেকর্ড করা হতে পারে।’ এ বিষয়ে নগদ কর্তৃপক্ষ সময়ের আলোকে বলেন, গ্রাহকদের ফোন রেকর্ড করার আগেই কিন্তু রেকর্ডের বিষয়টি গ্রাহককে জানানো হয়। ফোনে না চাইলে তিনি ফিজিক্যালি যোগাযোগ করতে পারেন। আর সব ফোন রেকর্ড করা হলেও সব সংরক্ষণ করা হয় না। যেগুলোতে সিরিয়াস সমস্যা বা পরামর্শ থাকে সেগুলো রেখে বাকিটা ডিলিট করে দেওয়া হয়।
আইন কী বলে? সংবিধানের ৪৩(খ) ধারায় বলা আছে, চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ে গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (২৬) ধারায় অনুমতি ছাড়া কারও ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী (অনুচ্ছেদ-১২) নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে আন্তর্জাতিক সনদ (অনুচ্ছেদ-১৭) জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী (অনুচ্ছেদ-১৪) এবং শিশু অধিকার সনদে (অনুচ্ছেদ-১৬) গোপনীয়তাকে অধিকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০১-এর ৭১ ধারায় টেলিফোনে আড়ি পাতার দণ্ডে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি অপর দুজন ব্যক্তির টেলিফোন আলাপে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়ি পাতে, তা হলে প্রথমত ব্যক্তির এ কাজ হবে একটি অপরাধ এবং তার জন্য তিনি অনধিক ২ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে শর্ত থাকে যে, ধারা ৯৭(ক)-এর অধীন সরকার থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এই ধারার বিধানাবলি প্রযোজ্য হবে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান সময়ের আলোকে বলেন, ফোন কোম্পানি বা কল সেন্টারগুলো গ্রাহকের কোনো অনুমতি ছাড়াই কল রেকর্ড করছে। এই রেকর্ডে গ্রাহকের সম্মতি আছে কি না নেই, সে বিষয়ে কোনো অপশন রাখা হয়নি। অনুমতি ছাড়া গ্রাহকের ফোন রেকর্ড করার বিষয়ে আইনে সরাসরি কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে এই রেকর্ড দ্বারা কারও প্রাইভেসি নষ্ট হলে কী করণীয় সে বিষয়ে ব্যাখ্যা আছে। গ্রাহকের দেওয়া কল দিয়ে প্রশিক্ষণ কিংবা পর্যালোচনা করার কোনো আইন নেই। যদি কোনো গ্রাহক এটি না চান তা হলে বিটিআরসিতে অভিযোগ জানাতে পারেন। আর এই রেকর্ড যদি কোনো থার্ড পার্টিকে দেওয়া হয় এবং তা দিয়ে যদি ওই ব্যক্তির প্রাইভেসি নষ্ট হয় তা হলে আদালতে মামলা করতে পারবেন। সে সঙ্গে তাকে উল্লেখ করতে হবে, কোন কথাটি দিয়ে তার প্রাইভেসি নষ্ট হয়েছে।
বাংলাদেশ মোবাইল ফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, গ্রাহকের ব্যক্তিগত ফোনালাপ তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা আমাদের সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে। আইনে সুস্পষ্ট বলা রয়েছে, গ্রাহকের ফোনালাপ এবং তথ্য সম্পূর্ণভাবে নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্র এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গ্রাহকের এই নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। গ্রাহকের ফোন কল রেকর্ডের আগে গ্রাহকের অনুমতি নেওয়া উচিত। প্রায় সময় দেখা যায়, ব্যক্তিস্বার্থ, এমনকি রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থে বিভিন্ন ব্যক্তির মানমর্যাদা ক্ষুণ্ন করতেই ব্যক্তিগত টেলিফোন আলাপ প্রায়ই প্রচার এবং প্রকাশিত হচ্ছে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। দেখা যায়, কোনো গ্রাহকের টাকা কেটে নিলে সে কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে উত্তেজিত ভাষায় ভুলভাল কথা বলছে, যা অনেকের কাছে হাস্যরসের খোরাক হিসেবে ফেসবুক ও ইউটিউবে ঘুরে বেরাচ্ছে। এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে এই শিল্পের প্রতি মানুষের বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা থাকবে না এবং নিরাপত্তা হারাবে।
বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র সময়ের আলোকে বলেন, গ্রাহকের অনুমতি ছাড়া ফোন রেকর্ড করা অন্যায়। বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। বিস্তারিত জেনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।