কুটির শিল্প খুবই ক্ষুদ্রায়তন শিল্প। স্বল্প মূলধনের সাহায্যে কুটিরবাসী গরিব লোকেরা ঘরে বসে কিংবা ক্ষুদ্রায়তন কারখানায় যেসব পণ্য উৎপাদন করে তাদের কুটির শিল্প বলে। বাংলাদেশের শিল্প আইন অনুসারে যে শিল্পে ২০ জনের অধিক লোক নিয়োগ করা হয় না তাকে ক্ষুদ্রায়তন বা কুটির শিল্প বলে। কলকারখানায় যেমন যন্ত্রের সাহায্যে অতি অল্পসময়ে ও অতি অল্প ব্যয়ে পণ্য উৎপাদন করা যায়, কুটির শিল্পে তা সম্ভব নয়। কিন্তু শিল্পীর হস্তে উৎপাদিত দ্রব্য যেমন সুন্দর ও দীর্ঘস্থায়ী হয়, কলকারখানায় প্রস্তুত দ্রব্য সেরূপ হয় না। তা ছাড়া এ শিল্পে মূলধন যেমন কম লাগে তেমনি পরিবারের সবার শ্রম এতে কাজে লাগানো যায়। কুটির শিল্প বলতে বুঝি ঘরে বসে নিজ হাতে উৎপাদিত দ্রব্যকে, যার উৎপাদন খরচ অতি সামান্য। কুটির শিল্প গ্রামের মানুষের কাছে লোকশিল্প নামে পরিচিত।
গ্রামের কৃষক পরিবারের মেয়েরা ঘরে বসে অবসর সময়ে কুটির শিল্পজাত সামগ্রী তৈরি করে। মহিলাদের পাশাপাশি পুরুষরাও বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে কুটির শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। তা ছাড়া কামার, কুমার, তাঁতি, স্বর্ণকার, শাঁখারি, কাঁসারিরা জীবিকা অর্জনের জন্য যেসব জিনিস তৈরি করেন তাও কুটির শিল্প। বাঁশ ও বেতের তৈরি গৃহস্থালি শৌখিন জিনিস যেমন - চেয়ার, টেবিল, শো-পিস ইত্যাদিও কুটির শিল্পজাত পণ্য। কুটির শিল্পে বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। একসময় ঢাকার বিখ্যাত মসলিন কাপড়ের বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছিল। কালক্রমে এই শিল্পের অবলুপ্তি ঘটলেও অপরাপর কুটির শিল্পের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ কম সমৃদ্ধ ছিল না। জামদানি শাড়ির গৌরব ও জনপ্রিয়তা আজও বিদ্যমান । মৃৎশিল্প, তাঁতশিল্প, বেতশিল্প, স্বর্ণ-রৌপ্য নির্মিত অলংকার, কাঁসার জিনিসপত্র, চামড়ার কাজ ইত্যাদি শিল্পসম্ভার এ দেশের অতীতের অর্থনীতিক অবস্থা উন্নয়নে সাহায্য করেছিল।
এ ছাড়া টুপি, সাবান, লজেন্স, ঝুড়ি, ঝাটা, মাদুর, পাখা, মাছ ধরার যন্ত্রপাতি, সূচি শিল্পের কাজ, পাটি, চাটাই, মোড়া, জাল, কাষ্ঠ নির্মিত দ্রব্যও কুটির শিল্প। বাংলাদেশের অনেক দরিদ্র লোক এখনও এসব কুটির শিল্পের ব্যবসায় অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তবে গ্রামগঞ্জে এখনও কিছু কিছু তাঁতশিল্প লক্ষ করা যায় কিন্তু অতীতের সেই গৌরবময় ঐতিহ্য বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। আমাদের কুটির শিল্পের অবনতির অনেক কারণ রয়েছে। প্রথমত, যন্ত্রের প্রতিযোগিতা। যন্ত্র শিল্পের ব্যাপক প্রসারের ফলে কুটির শিল্পের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। যন্ত্রের সাহায্যে অল্পসময়ে বেশি পণ্য উৎপাদন করা যায় বলে মূল্যও কম পড়ে। ফলে কুটির শিল্প যন্ত্র শিল্পের নিকট হার মানতে বাধ্য হচ্ছে। দ্বিতীয়ত আমাদের রুচির পরিবর্তনে দেশীয় কুটির শিল্পজাত দ্রব্যগুলো গুণে শ্রেষ্ঠ হলেও আমরা কলে প্রস্তুত দ্রব্যসমূহের বাহ্য ঔজ্জ্বল্য ও সূক্ষ্ম কারুকার্যে মুগ্ধ হয়ে সেগুলো ক্রয় করি। তৃতীয়ত, দেশি শিল্পের প্রতি আমাদের অনীহা। চতুর্থত, স্বদেশপ্রেমের অভাব। পঞ্চমত, বিদেশি কাপড়ের প্রতি মোহ। দ্রব্য ক্রয়ের আগে আমরা দেশি কি বিদেশি অথবা কুটির শিল্পজাত না যান্ত্রিক শিল্পজাত এসব চিন্তা না করে এটি সুলভ না মূল্যবান তাই বিবেচনা করি।
আমাদের এই স্বার্থপরতার ফলে দেশি কুটির শিল্পগুলোর চরম অবনতি ঘটছে। দেশের প্রকৃত সমৃদ্ধির জন্য যান্ত্রিক শিল্পের পাশাপাশি কুটির শিল্পেরও উন্নয়ন অপরিহার্য। স্বল্প মূলধনে এর উৎপাদন সম্ভব বলে গরিব লোকেরা নিজ নিজ সুবিধানুযায়ী পণ্য উৎপাদন করতে পারে। তাই দেশের ও দশের স্বার্থেই কুটির শিল্পের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা আবশ্যক। বাংলাদেশ এখনও শিল্পে অনুন্নত বলে কুটির শিল্পের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম। কুটির শিল্পের অগ্রগতি ছাড়া আমাদের অর্থনীতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব নয়। শুধু কলকারখানার যান্ত্রিক উৎপাদন দেশের আর্থিক সমস্যার ও বেকার সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না। এজন্য বৃহৎ যন্ত্র শিল্পের পাশে কুটির শিল্পের স্থান দিতে হবে। শিল্পোন্নয়নের অভাবে আমাদের দেশে কৃষির ওপর দিন দিন জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কুটির শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে জমির ওপর জনসংখ্যার চাপ হ্রাস করা যাবে। কুটির শিল্পের উন্নতির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে অশিক্ষিত বেকার সমস্যার খানিকটা সমাধান করা সম্ভব। আমাদের দেশের মেয়েরা অতিমাত্রায় পর্দানশীন বলে তারা ঘরের বাইরে পুরুষের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক নয়। কুটির শিল্পের উন্নতির মাধ্যমে এসব পর্দানশীন মহিলাকে কাজে লাগানো যাবে। এতে দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে কুটির শিল্পে ব্যবহারের উপযোগী প্রচুর কাঁচামাল রয়েছে।
কুটির শিল্পের দ্রুত সম্প্রসারণের মাধ্যমে এই সব কাঁচামাল ব্যবহার করে উৎপন্ন দ্রব্য বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে। আমাদের দেশে পল্লী অঞ্চলে কুটির শিল্প সম্প্রসারিত হলে কৃষকদের মাথাপিছু আয় বাড়বে। কারণ এতে কৃষিকাজ ছাড়াও কুটির শিল্প থেকে বাড়তি আয় উপার্জন করা যাবে। ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। দেশের আর্থিক সমস্যা সমাধান করতে হলে যন্ত্র শিল্পের পাশাপাশি কুটির শিল্পের উন্নতি অতীব প্রয়োজনীয় যন্ত্র শিল্পের কল্যাণে ব্যক্তিবিশেষ, গোষ্ঠীবিশেষ ধনী হয়ে ওঠে আর লাখ লাখ কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষ দারিদ্র্যের কঠোর নিষ্পেষণে পীড়িত হতে থাকে। কুটির শিল্প অর্থকে এক স্থানে স্তুপীকৃত হতে দেয় না, বরং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষক, শ্রমিকসহ সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। এতে দেশের আপামর জনসাধারণ যেমন লাভবান হয় তেমনি দেশও উন্নতির দিকে এগিয়ে যায়।
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়