রোগীর সেবায় পুণ্য অর্জন
প্রকাশ: বুধবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২১, ১১:১৮ পিএম (ভিজিট : ১২২৪)
সাইফুল্লাহ বিন কাসিম
ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে ‘ইয়াদাতুল মারিজ’ তথা অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া। নবীজি (সা.) এ ব্যাপারে খুব তাগিদ ও গুরুত্বারোপ করেছেন। উম্মতকে তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যে, এটাও একটা মহান ইবাদত। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মাধ্যমে পারিবারিক ও সামাজিক সৌহার্দপূর্ণ বন্ধন দৃঢ় হয় এবং পরস্পর ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। হাদিস শরিফের সব গ্রন্থের প্রতি গুরুত্বারোপ করে বিশদ বিবরণ এসেছে। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা রোগীকে দেখতে যাও এবং জানাজায় অংশগ্রহণ কর। কেননা, তা তোমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১১১৮০)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে একটি হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছেÑ রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আদম সন্তানকে সম্বোধন করে বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে যাওনি! বান্দা বলবে, আপনি তো বিশ^ জাহানের পালনকর্তা; আমি আপনাকে কীভাবে দেখতে যেতে পারি? আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, তুমি তাকে দেখতে গেলে তার কাছে আমাকে পেতে। (মুসলিম : ২৫৬৯)
শুধু অসুস্থ মুসলিম নয়; অমুসলিম, অসুস্থ প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদেরও দেখতে যাওয়ার নির্দেশ রয়েছে। অমুসলিমদের কাছে ইসলামের অনুপম আদর্শ তুলে ধরার দাওয়াতি মাধ্যমও বটে। যেসব অমুসলিম রাসুলকে (সা.) বিভিন্নভাবে কষ্ট দিয়েছিল, তারা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, রাসুল (সা.) সব ক্রোধ ও ক্ষোভ ভুলে তাদেরকে দেখতে গিয়েছেন, তাদের খোঁজখবর রেখেছেন, সেবা-শুশ্রƒষা করেছেন; তারা তার এ মহানুভব আদর্শ দেখে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। হযরত আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, এক ইহুদি যুবক রাসুল (সা.)-এর খেদমত করত। একবার সে অসুস্থ হয়ে যায়। রাসুল (সা.) তাকে দেখতে যান। তার মাথার কাছে বসে তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। সে তার পিতার দিকে দৃষ্টি ফেরাল। তার পিতা বলল, তুমি আবুল কাসেমের অনুসরণ কর। অতঃপর সে ইসলাম গ্রহণ করল। রাসুল (সা.) ‘সব প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য, যিনি এই যুবককে জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন’ বলতে বলতে বের হয়ে এলেন।’ (বুখারি : ১৩৫৬; আবু দাউদ : ৩০৯৫)
রোগীকে দেখতে যাওয়ার অনেক ফজিলতের কথা হাদিসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিতÑ রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি সকালবেলা কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যায় সত্তর হাজার ফেরেশতা বিকাল পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করতে থাকে। আর বিকালে রোগী দেখতে গেলে সকাল পর্যন্ত সত্তর হাজার ফেরেশতা তার জন্য দোয়া করতে থাকে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি ফলের বাগান তৈরি করা হয়।’ (আবু দাউদ : ৩০৯৮; তিরমিজি : ৯৬৯; ইবনে মাজা : ১৪৪২)। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোগীকে সেবা-শুশ্রƒষা করতে যায়, আকাশ থেকে একজন ঘোষণাকারী তাকে লক্ষ করে বলেন, তুমি সুখী হও এবং তোমার এই পদচারণা সুখকর হোক, তুমি জান্নাতে নিজ আবাস তৈরি করে নিলে!’ (ইবনে মাজা : ১৪৪৩)। হযরত মালেক ইবনে আনাস (রা.) থেকে বর্ণিতÑ রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো রোগীকে দেখতে রওয়ানা হলো, সে আল্লাহর রহমতের সাগরে সাঁতার কাটতে
থাকল, যতক্ষণ না সে তথায় গিয়ে বসে। যখন সে গিয়ে বসল তখন সে রহমতের সাগরে ডুব দিল। (মুসনাদে আহমদ : ১৩৬৭৩)। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হযরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিতÑ রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যখন কোনো মুসলমান অন্য অসুস্থ মুসলমান ভাইকে দেখতে যায় তখন সে ফিরে আসা পর্যন্ত জান্নাতের ফল বাগানে বিচরণ করতে থাকে। (মুসলিম : ২৫৬৮)
রোগী দেখতে যাওয়ার কিছু সুন্নত ও আদব রয়েছে। এসবের প্রতি খুব খেয়াল রাখা চাই। প্রথমত অজু সহকারে রোগীকে দেখতে যাওয়া। হযরত আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিতÑ রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কোনো অসুস্থ মুসলমানকে দেখতে যায়, তাকে জাহান্নাম থেকে ষাট বছর সমপথ দূরে রাখা হবে। (আবু দাউদ : ৩০৯৭)। রোগীকে সান্ত্বনার বাণী শোনানো উচিত। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিতÑ রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা যখন কোনো রোগীর কাছে যাবে, তার জীবন সম্পর্কে আনন্দদায়ক কথা বলবে, তাকে সান্ত্বনার বাণী শোনাবে, (এ সান্ত্বনার বাণী) ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবে না, যা ঘটার তাই ঘটবে কিন্তু তার মন সান্ত্বনা লাভ করবে, যা রোগী দেখতে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য। (তিরমিজি : ২০৯৪)। রোগীর কাছে বেশি সময় অবস্থান করবে না। কারণ এতে রোগীর কষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হ্যাঁ রোগীর কাছে অবস্থান করা, যদি রোগীর অন্তরের প্রশান্তি ও সান্ত্বনার কারণ হয়। তা হলে দীর্ঘ সময় অবস্থান করাতে কোনো সমস্যা নেই। হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়িব (রহ.) বলেন, রোগী দেখার উত্তম পন্থা হলোÑ রোগীর কাছ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসা। (শুয়াবুল ঈমান : ৯২২২)
রোগীর সুস্থতার জন্য দোয়া করা চাই। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিতÑ রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, মৃত্যুপথযাত্রী রোগী ব্যতীত যেকোনো রোগীর কাছে এই দোয়া সাতবার পাঠ করা হলে, সে রোগী অবশ্যই ওই রোগ থেকে মুক্তি লাভ করবেÑ ‘আস আলুল্লাহাল আজিম রাব্বাল আরশিল আজিম আইয়াশফিয়াকা’ অর্থাৎ, আরশে আজিমের মহান অধিপতি রবের কাছে প্রার্থনা করছি, যেন তিনি তোমাকে সুস্থ করে দেন।’ (আবু দাউদ : ৩১০৬)। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে অন্য একটি দোয়া বর্ণিত হয়েছে। রাসুল (সা.) যখন কোনো অসুস্থকে দেখতে যেতেন তখন পড়তেনÑ ‘লা বাসা তাহুরুন ইনশাল্লাহ’ অর্থাৎ, অসুবিধা নেই, আল্লাহর ইচ্ছায় তুমি সুস্থতা করবে।’ (বুখারি : ৫৬৫৬)। আল্লাহ তায়ালা এসব বিষয়াবলির ওপর আমল করার তওফিক দান করুক।
লেখক : আল-জামেয়াতুল আজিজিয়া দারুল উলুম ইসলামিয়া, দৌলতখান, ভোলা