ই-পেপার রোববার ১৯ মে ২০২৪
রোববার ১৯ মে ২০২৪

আগে শিশুদের জীবন নিয়ে ভাবতে হবে
প্রকাশ: রবিবার, ৫ মে, ২০২৪, ৭:৫০ এএম  (ভিজিট : ১৯৬)
প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ চলছে। জনজীবন অতিষ্ঠ। কেউ কেউ বলছেন, এমন তাপপ্রবাহ তারা জীবনে দেখেননি। মনে পড়ে না তাদের এমন গরমের অভিজ্ঞতা। এদিকে হিটস্ট্রোকে প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। দেখা দিয়েছে নানা রোগের প্রকোপ। গরমে যাদের জীবন বিপন্ন ও বিধ্বস্ত তারা বয়সের দিক থেকে ছোট অর্থাৎ শিশু এবং যারা অপেক্ষাকৃত বয়স্ক অর্থাৎ বৃদ্ধ। এই দুই বয়সের ব্যক্তিরা অতিগরম বা শীতে অতিদ্রুত অসুস্থ হয়। বা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে তারাই আক্রান্ত হয় সবার আগে। এই বয়সের মানুষজন আবার যদি দরিদ্র বা নিম্নবিত্ত হয়, তা হলে এক আঘাতের ওপর আরেকটা আঘাত পরে। প্রকৃতির এমন বিরূপ আচরণকে আয়ত্তে আনার কোনো ধরনের সক্ষমতা, সামর্থ্য তাদের নেই, থাকে না।

স্মরণকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চলছে। আবহাওয়া অধিদফতর, হিট অ্যালার্ট জারি করেছে। শুরুতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ড কর্তৃক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে আবার খুলে দিলে শিক্ষার্থীদের সুস্থতার কথা চিন্তা করে হাইকোর্ট বন্ধের আদেশ জারি করেন। সংবাদমাধ্যমে দেখা গেল, মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হাইকোর্টের এই রায়ের প্রতি উত্তরে বা পরিপ্রেক্ষিতে আপিল করবেন। ব্যাপারটা এমন মনে হলো যে, আদালত ও সরকারের মাঝখানে কোনো সমন্বয় নেই। প্রচণ্ড গরমে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে হাইকোর্টের আদেশের প্রতি প্রতিমন্ত্রীর সশ্রদ্ধ সম্মতি প্রদর্শন দরকার ছিল বলে অনেকে মনে করছেন। বিশেষ করে অভিভাবকগণ। আমারও তাই মনে হয়েছে। আদালত যা বলেছেন তা শিক্ষার্থীদের শারীরিক সুস্থতার স্বার্থে। এটাকে প্রতিপক্ষের সীমানায় টেনে আনার কী যুক্তি বা উদ্দেশ্য মন্ত্রণালয়ের, তা ভেবে অনেকেই বিস্মিত। যা হোক, স্কুল বন্ধ ও খোলার এই খেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কোমলমতির শিশুরা। তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

টিভির পর্দায় দেখলাম, পাঠ্যবই ও খাতা দিয়ে অল্পবয়সি শিক্ষার্থীরা বাতাস নিচ্ছে। গরমকালে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। লোডশেডিংয়ের সাক্ষাৎ কমবেশি সবাই পায়। একে তো লোডশেডিং, তার ওপর প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ, কী করে শিক্ষার্থীরা সুস্থ থাকে বা থাকবে? একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে বলতে শুনলাম যে, এমন গরমে শিক্ষার্থীদের স্কুলে থাকা ভালো, ঘরের বাইরে থাকার চেয়ে। তার কাছে প্রশ্ন, স্কুল কি কারোর ঘরের মধ্যে? নাকি স্কুলে যেতে ঘর থেকে বের হতে হয় না? একজন অভিভাবক বলছিলেন, যারা এমন সব কথা বলেন তারা আসলে বাস্তবতা জানেন না বা বোঝেন না। কথা বলার জন্যই কথা বলেন। এরা গরম কি টের পান না। কারণ, এসি রুমে থাকেন, এসি গাড়িতে চলেন। 

একজন অভিভাবক জানতে চাইলেন, আমাদের সন্তানদের জীবন আগে, নাকি স্কুলে যাওয়াটা আগে? এত গরম, কী করে বাচ্চাটাকে নিজের হাতে শেষ করি? আর স্কুলে কি এই সময়ে পড়াশোনা হয়? নামকাওয়াস্তে ক্লাস হয়। যারা ক্লাসে থাকেন না, তারা কী করে বুঝবেন, ক্লাসে কী করানো হয়। শিক্ষকরাও তো গরমে নাস্তানাবুদ।

ইংলিশ মিডিয়ামের এক স্কুলে গিয়ে দেখি ক্লাস চলছে। প্রশ্ন করলাম, এমন প্রচণ্ড গরমে স্কুল না বন্ধ ঘোষণা দিয়েছে সরকার? একজন জবাব দিলেন, যেসব স্কুলে এসি আছে, তা খোলা রাখতে বলেছে। সত্য-মিথ্যা জানি না। বিস্মিত হয়ে বললাম, তাই নাকি! পরক্ষণে মনে হলো, অসম্ভব কী। কত অসম্ভবই না সম্ভব হয়ে টিকে যাচ্ছে। অন্তত শিক্ষাব্যবস্থায় গেল অতিমারি কোভিডে অনলাইন ক্লাস চালুর সময়ে কেউ একবারও ভাবল না যে, কতজন শিক্ষার্থীর হাতে ডিভাইস আছে। এমনিতে করোনাকালে সবকিছু থমকে পড়ে। অসংখ্য চাকরিজীবী চাকরি হারায়। লকডাউনে দিনমজুররা কর্মহীন হয়ে পড়ে। চরম অর্থনৈতিক মন্দায় মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তকে আলাদা করে দেখার সুযোগ ঘটে না। তেমন একটা অবস্থায় অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এই সমাজে কার সামর্থ্য আছে, আর কার সামর্থ্য নেই। শ্রেণিবৈষম্য এভাবেই সমাজে তৈরি হয়। আমাদের সমাজে সব পরিকল্পনা যেন সামর্থ্যবান বাবা-মায়ের সন্তানদের কেন্দ্র করে করা হয়। 

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের উন্নত চিন্তা-চেতনার প্রয়োজনবোধ খুব একটা দেখা যায় না। যা দেখা যায়, দায়সারা, অপরিণত, অপরিপক্ব পরিকল্পনা ও জগাখিচুড়ি ব্যবস্থাপনা। শিক্ষা যে জাতির অস্তিত্বের মূল স্তম্ভ এবং আগামীর বাংলাদেশের আলোকবর্তিকা, সেই সত্য অনুধাবনের কোনো তাগাদা কোথাও মেলে না। যেনতেনভাবে চালানো হচ্ছে এই কার্যক্রম। 

যখন যার যা মনে হচ্ছে, তখন সেটাই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। একজন অভিভাবক বলছিলেন, তিনি তার সন্তানকে বাংলা মিডিয়াম থেকে ইংলিশ মিডিয়ামে নিয়ে আসবেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, তার সন্তান গত দুই বছর কিছুই শেখেনি। যে কারিকুলাম করা হয়েছে তাতে তার, সন্তান পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। প্রচণ্ড রকম বিরক্ত পড়ালেখা নিয়ে। শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীর আগ্রহ তৈরি করা এবং তার উপযোগী বিষয় নির্ধারণ করা দায়িত্বশীলদের কাজ। আমরা কেমন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ব, সেটা নির্ভর করে কী শেখানো হচ্ছে তার ওপর। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া না হলে কাংখিত উন্নয়ন কখনোই হবে না। যা হোক, একটা সুন্দর শিক্ষাব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। 

প্রতিটি শিক্ষার্থীর সমান অধিকার রয়েছে তার শিক্ষা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে। যে শিশুটি শহরে পড়াশোনা করতে গিয়ে যেসব সুবিধা পাচ্ছে, সেই একই সুবিধা পেতে হবে গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পড়াশোনা করা শিশুটির। এই বিষয়কে নিশ্চিত করা দায়িত্বশীলদের আরেকটি অন্যতম কাজ। কিছু দিন আগে একটি টিভি চ্যানেলের সংবাদে দেখা গেল, একটি সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যার চেয়ে শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা অনেক বেশি। আবার শিক্ষকতা না করে, বহুদিন ধরে বিদেশে অবস্থান করে মাসের পর মাস বেতনসুবিধা গ্রহণ করছে। যদি অত্যন্ত সতর্কতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে অনিয়মগুলো বিচার- বিশ্লেষণ করা হয় তা হলে দেখা যাবে যে, যোগ্য ব্যক্তির আকাল এই সেক্টরে।

তা ছাড়া শিশুদের বিষয়ে আমাদের বেশিরকম যত্নশীল হওয়া দরকার। তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, মানসিক সুস্থতা ও বিকাশ যদি বাস্তবতার আলোকে সময়োপযোগীভাবে যথাযথ সঠিক ও পরিপূর্ণভাবে করার ব্যবস্থা গৃহীত না হয় তা হলে তারা ঝুঁকিতেই থেকে যাবে। যে ঝুঁকি হয়তোবা গতানুগতিক দৃষ্টিতে দেখা যাবে না, কিন্তু যার ক্ষত রাষ্ট্রের শেকড়ে ঠাঁই নেবে। কারণ, আজকের শিশুই আগামীর বাংলাদেশ। 

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা-এই তিনটি বিষয় শিশুদের জন্য সর্বাগ্রে নিশ্চিত করা জরুরি। নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় ও সঠিক উদ্যোগ। এখানে মনে রাখা দরকার যে, শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বুঝতে সক্ষম এমন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও সমাজ বিশ্লেষকদের সমন্বয়ে উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যেনতেনভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করলে ফলাফল কখনোই কাক্সিক্ষত হবে না। উপরন্তু বিপরীত ঘটনা ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে কোনো সঠিক ডাটা আছে কি না যে, বাংলাদেশের শিশুদের কত শতাংশ নিয়মিত স্কুলে যায়, কত শতাংশ শিশু পড়াশোনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করে কিংবা করে না এবং শিশুরা কেমন শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী। থাকলে ভালো। আর না থাকলে এই বিষয়ে পরিসংখ্যানভিত্তিক গবেষণা জরুরি।
 
সরকারিভাবে যত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় বা হবে তার আগে সেই বিষয়ের ওপর গবেষণা করা অতি জরুরি। সড়ক সংস্কারের মতো যেনতেনভাবে পরিকল্পনা অন্তত শিশুদের বেলায় নেওয়া যাবে না। নেওয়ার চেষ্টাকে চরম দায়িত্বহীনতা ও অযোগ্যতা বলে বিবেচনা করতে হবে। কারণ একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করার উপায় হলো সেই রাষ্ট্রের শিশুদের ঝুঁকিতে রেখে দেওয়া, ঝুঁকিতে ঠেলে দেওয়া।

পরিশেষে বলব, ক্লাসরুমে শুধু পাঠদান নয়, পাঠদানের উপযুক্ত পরিবেশ, সঠিক কারিকুলাম, ছাত্রদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নিরাপত্তা নিশ্চিত ইত্যাদি সব বিষয় নিয়েই শিক্ষাব্যবস্থা। সব বিষয়ে সমান গুরুত্ব আরোপ করতে হবে এবং তা সুচিন্তিতভাবে ও সমন্বয়ে।

কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close