যাদের অবদানে চামড়া শিল্প রফতানি আয়ের অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছে। সেই শ্রমিকরাই হচ্ছেন অবহেলার শিকার। ২০১৮ সালে ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১৩ হাজার নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও ৬ বছরে তা কার্যকর হয়নি। এমন অবস্থার মধ্যেই খাদ্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় ট্যানারি শিল্পের জন্য শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২২ হাজার ৭৭৬ টাকা প্রস্তাব করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তবে এটি অনুমোদন পেলেও বাস্তবায়ন হবে কি না তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।
শনিবার সিপিডির ধানমন্ডির কার্যালয়ে ‘ট্যানারি শিল্পে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব প্রস্তাবনা উঠে আসে। সিপিডির গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। সিপিডির সিনিয়র গবেষক তামিম আহমেদ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
সিপিডি বলছে, শ্রমিকদের খাদ্যমূল্য ২০ হাজার ৫৬৪ ও নন-ফুড মূল্য ১২ হাজার ৮৮১ টাকা হিসাবে মাসে মোট ৩৩ হাজার ৪৪৫ টাকা প্রয়োজন। অ্যাঙ্কর সিস্টেমে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ও তাদের আয়কেও বিবেচনায় নেওয়া হয়। অর্থাৎ পরিবারের অন্য সদস্যদের আয় ও বর্তমান বাজার বিবেচনায় নেওয়া হয়।
সেই হিসাবে সিপিডি মনে করছে ন্যূনতম মজুরি হওয়া উচিত ২২ হাজার ৭৭৬ টাকা। একই সঙ্গে আমাদের প্রস্তাব থাকবে গ্রেডিং সিস্টেম ঠিক করে একটি গ্রেডে আনা। এই খাতে গ্রেড উন্নয়নের সুযোগ কম, কারণ একেকটি গ্রেডের কাজ একেক রকম। যেহেতু পদোন্নতির সুযোগ নেই, তাই গ্রেডের মধ্যে কয়েকটি ভাগ করে (যেমন-গ্রেড-৫-এর এ, বি ও সি) সাব-গ্রেড করার প্রস্তাব রয়েছে। এর ফলে পদোন্নতির সুযোগ থাকবে ও শ্রমিকদের কাজে উৎসাহ বৃদ্ধি পাবে।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পোশাক শিল্পের পর যে শিল্পটি গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে চামড়া বা চামড়াজাত পণ্য। ট্যানার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুসারে ২০০-এর মতো ট্যানারি শিল্প রয়েছে। সাভারের ট্যানারি শিল্পে ১২৭টি প্লটে বিভিন্ন রকমের ট্যানারি প্রতিষ্ঠান সক্রিয় রয়েছে। ২০২৩ সালের চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছিল ১.২ বিলিয়ন ডলার। যার ভেতরে ট্যানারি শিল্প থেকে এসেছে ১২৩ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ বিলিয়ন ডলারের রফতানি খুঁজছে সে হিসাবে চামড়াজাত পণ্য গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত হতে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, চামড়াজাত পণ্য নিয়ে আলোচনা এলে সবচেয়ে বেশি পরিবেশগত বিষয়টি আলোকপাত করা হয়। আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে ন্যূনতম মজুরি। মূলত ট্যানারি শিল্প খাতে শ্রমিকদের মজুরি। ট্যানারি শিল্পের ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে হয়তো বোর্ড মজুরি সুপারিশ করবে। ট্যানারি খাতে ন্যূনতম মজুরি অন্যান্য খাতের তুলনায় অনেক বেশি রয়েছে। তার মানে এই নয় যে, ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার দরকার নেই। এ জন্য সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে এই শিল্পে শ্রমিক ইউনিয়ন অত্যন্ত শক্তিশালী পর্যায়ে রয়েছে। আমাদের গবেষণায় এই খাতে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২২ হাজার ৭৭৬ টাকা প্রস্তাব এসেছে, আমরা জানি শ্রমিকদের দাবি ২৫ হাজার টাকা আর মালিকদের প্রস্তাবনা ১৫-১৬ হাজার টাকা। আমি আশা করছি মজুরি বোর্ড সব পক্ষের প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।
সিডিপির গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১১ সালে সর্বপ্রথম ট্যানারি শিল্পের জন্য ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়েছিল, যার পরিমাণ ৮ হাজার ৭৫০ টাকা। ২০১৮ সালে সেটা বৃদ্ধি করে শহর অঞ্চলের জন্য ১৩ হাজার ৫০০ টাকা ও গ্রাম অঞ্চলের জন্য ১২ হাজার ৮৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে যে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেটা কতগুলো প্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়ন করা হয়েছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সিপিডির গবেষণায় দেখা গেছে ২০২৪ সালে এসেও দেখা গেছে ৬০ শতাংশ কারখানা ওই বেতন দিচ্ছে না। প্রতি বছর ৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি পাওয়ার কথা থাকলেও সেটা বিবেচনায় বাস্তবায়ন হার অনেক কম পাওয়া গেছে।
সিপিডি অ্যাঙ্কর মেথডে ৩৫টি ট্যানারির ওপর গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে। গবেষণা নিয়ে সিপিডির গবেষক তামিম আহমেদ বলেছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ট্যানারি শিল্পের জন্য আলাদা ন্যূনতম মজুরি নেই। ওইসব দেশে সব শিল্পের একই হারে ন্যূনতম মজুরি রয়েছে। তবে ভারতে রাজ্যভিত্তিতে ন্যূনতম মজুরি রয়েছে। ভারতের কেরালায় ১৪৬, তামিলনাডুতে ১৩৮, উত্তর প্রদেশে ১২৩ ও পশ্চিমবঙ্গে ১১৭ মার্কিন ডলার ন্যূনতম মজুরি রয়েছে। অন্যদিকে ভিয়েতনামে ১৭১, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে ১৮৬ ও ২৫৫ মার্কিন ডলার। সেখানে বাংলাদেশে ট্যানারি শিল্পে ন্যূনতম মজুরি ১২৩ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশের খাদ্যপণ্যের মূল্য হিসেবে অনেক বলে মনে করছি।
গবেষণায় বলা হয়েছে, গড়ে প্রতিটি ট্যানারিতে ২১ জনের মতো শ্রমিক কাজ করে। যার মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা খুবই কম। শ্রমিকরা অনেকেই তাদের ন্যূনতম মজুরি সম্পর্কে জানেন না। ৬৫ শতাংশ মজুরি সময়মতো দেওয়া হয় না। অন্যদিকে শ্রমঘণ্টা অনেক বেশি। মজুরি সময়মতো না দেওয়া কিংবা কম দেওয়ার বড় কারণ রফতানি ও দেশের বাজারে বিক্রি কমে যাওয়া।